Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য পথে পথে বাবুদের প্রদর্শনী: পালকি, বাজনা আর দালানকোঠা

পথে পথে বাবুদের প্রদর্শনী: পালকি, বাজনা আর দালানকোঠা

কলকাতার বাবু কালচার

কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: কলকাতার বাবুদের ইতিহাসে পথের প্রদর্শনী এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। তারা শুধু বাড়ির ভেতরে বিলাসিতা করেই সন্তুষ্ট থাকতেন না। বরং শহরের পথে পথে তারা নিজেদের ঐশ্বর্য প্রদর্শন করতেন এমনভাবে, যাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের অন্যান্য অভিজাতরা তাদের ধনসম্পদের ঝলক স্পষ্ট দেখতে পান। সেই সময়ে কলকাতার রাস্তায় বাবুদের শোভাযাত্রা ছিল এক অসাধারণ দৃশ্য, যা কেবল আভিজাত্যের প্রতীকই নয় বরং এক ধরনের সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল।

বাবুরা বাইরে বের হলে সাধারণভাবে বের হতেন না। তাদের জন্য তৈরি করা হতো বিশেষ পালকি, যেগুলোতে রুপো বা সোনার আস্তরণ থাকত। পালকির ভেতরে থাকত নরম মখমলের আসন, পাশে থাকত রুপোর হুঁকো। পালকির বাহকেরাও বিশেষ পোশাক পরে থাকতেন, যাতে পুরো দৃশ্যটি আরও চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। পালকির সামনে বাজতে থাকত ঢাক, কাঁসা, শানাই, আবার কোথাও কোথাও থাকত আস্ত ব্যান্ডপার্টি। এক বাবু রাস্তায় বের হলেই পুরো মহল্লা জেনে যেত।

শোভাযাত্রা কেবল পালকি আর বাজনাতেই সীমাবদ্ধ থাকত না। বাবুরা তাদের সঙ্গে রাখতেন চাকরবাকর, দাসদাসী এবং কখনো কখনো হাতি বা ঘোড়ার গাড়িও। ঘোড়ার গাড়িগুলো সাজানো থাকত ফুল আর রঙিন কাপড়ে। বিশেষ উৎসব বা অনুষ্ঠানে বাবুরা প্রায় রাজাদের মতো শোভাযাত্রা করতেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ছুটে যেত সেই দৃশ্য দেখতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানাত, আর বাবুরা গর্বভরে হাত নেড়ে সেই শুভেচ্ছা গ্রহণ করতেন।

শহরে বাবুদের বাড়িগুলোও ছিল প্রদর্শনীর অংশ। দালানকোঠা শুধু বসবাসের জন্য নয়, বরং সমাজে মর্যাদা দেখানোর এক প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। একেকজন বাবু তাদের বাড়ি এমনভাবে সাজাতেন যাতে তা দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, ভেতরে কতটা ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। উঁচু দালান, ঝকঝকে বারান্দা, ঝাড়বাতি, রঙিন কাচের জানালা সবই ছিল একেকটি প্রতিযোগিতার অংশ। অন্য বাবুরা আবার তার চেয়ে বড় দালান বানিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে চাইতেন।

এই প্রদর্শনীর ফলে শহরে এক ধরনের কৃত্রিম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল। কার পালকি সবচেয়ে দামী, কার বাজনার দল সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ, কার বাড়ি সবচেয়ে বিশাল এ নিয়েই চলত গোপন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অনেক সময় বাবুরা অঢেল অর্থ ব্যয় করতেন শুধু এ প্রমাণ করার জন্য যে তারা অন্যদের চেয়ে ধনী। এতে সাধারণ মানুষের মনে বিস্ময় জাগলেও অনেকের কাছে তা হাস্যকর ঠেকত। তবু বাবুরা এসব প্রদর্শনীতে কোনো কার্পণ্য করতেন না।

কিন্তু ইতিহাস বলে এই বেহিসেবি প্রদর্শনীর শেষটা সুখকর হয়নি। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পালকি, বাজনা, দালানকোঠা তৈরি হলেও এর স্থায়িত্ব ছিল অল্পদিনের। বাবুদের অনেক পরিবার পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটে পড়ে, কারো কারো বাড়িঘর নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। সেই দালান আজ অনেক জায়গায় ভগ্নাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পথের প্রদর্শনী আজ আর নেই, কিন্তু অতীতের গল্প থেকে আমরা জানতে পারি কীভাবে সেই সময়ে ধনীরা নিজেদের সম্পদ দিয়ে শহরের রাস্তায় আভিজাত্যের মহড়া দিতেন।

কলকাতার বাবুদের এই প্রদর্শনী শুধু বিনোদনের গল্প নয়। এটি আসলে এক যুগের প্রতিচ্ছবি, যেখানে আভিজাত্য মানে ছিল অপচয় আর সম্মান মানে ছিল চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে, তবে ইতিহাসে তা রয়ে গেছে এক বিশেষ কৌতূহল হিসেবে। আজকের দিনে আমরা যখন সেই কাহিনি পড়ি, তখন বুঝতে পারি কীভাবে অপচয়ের প্রদর্শনী একসময় শহরের রাস্তায় রাজকীয় দৃশ্য তৈরি করলেও তা শেষ পর্যন্ত নিঃস্বতার পথে নিয়ে গিয়েছিল বাবুদের অনেক পরিবারকে।