আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চলতি মাসেই ভারতের সফরে যাওয়ার কথা ছিল নেপালের প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ (কেপি) শর্মা ওলির। কিন্তু সফরের আগেই দেশজুড়ে শুরু হয় অগ্নিগর্ভ গণআন্দোলন, যার ফলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে। ওলির পদত্যাগের পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি; বরং রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। এ ঘটনাকে ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন ও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব, যেখানে বহিরাগত শক্তির প্রভাব নিয়েই চলছে তীব্র বিতর্ক।
সন্দেহের আঙুল গুপ্তচর সংস্থার দিকে
গত ৩১ অগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের তিয়েনজ়িনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও)-র বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন ওলি। কাঠমান্ডুতে ফিরে ভারত সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। একই সময়ে নয়াদিল্লিও বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রিকে পাঠায় নেপালে। ঠিক তখনই যুব সমাজের নেতৃত্বে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এ সময়কার ঘটনাপ্রবাহ স্বাভাবিক নয়, বরং এর নেপথ্যে হাত রয়েছে বহিরাগত শক্তির। তাঁদের অভিযোগ, মার্কিন সিআইএ বা চীনের মিনিস্ট্রি অফ স্টেট সিকিউরিটি (এমএসএস)-এর মতো গুপ্তচর সংস্থা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
চীনের প্রভাব ও ভারতের অস্বস্তি
ওলি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নেপালের পররাষ্ট্রনীতিতে স্পষ্ট চীনমুখী ধারা লক্ষ্য করা যায়। গত বছর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) বিশেষ চুক্তি করে কাঠমান্ডু। এতে নেপালের অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। পরিস্থিতি পাল্টাতে ওয়াশিংটন ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন’ (এমসিসি)-এর মাধ্যমে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় নেপালকে। তবে এতে ওলির বেজিং ঘনিষ্ঠতায় ফাটল ধরেনি।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও ক্রমেই জটিল হতে থাকে। ২০২০ সালে লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা অঞ্চল নিয়ে সীমান্ত বিরোধ তীব্রতর হয়। ভারতের সঙ্গে এ বিরোধকে ওলি বারবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুললেও শেষ পর্যন্ত তিনিই নয়াদিল্লি ও বেজিং—দুই পরাশক্তিরই অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেন।
ভূরাজনীতির টানাপড়েন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের জেরে চীন ও ভারতের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। বাণিজ্যিক স্বার্থে নয়াদিল্লি ও বেজিং ক্রমশ কাছাকাছি আসে। বিশ্লেষকদের দাবি, ওলিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে চীন ভারতের বিপুল বাজার হারাতে রাজি ছিল না। ফলে ভূরাজনীতির জটিল সমীকরণে নেপাল ক্রমশ পরিণত হয় পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র।
ভেতরের ক্ষোভ, বাইরের আগ্রহ
তবে কূটনীতিকদের একাংশ মনে করছেন, কেবল বহিরাগত শক্তির দিকে আঙুল তোলা অতিসরলীকরণ। তাদের মতে, সাধারণ নেপালবাসীর ক্ষোভ ছিল প্রবল। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বেকারত্ব এবং অভিবাসনজনিত সংকট দীর্ঘদিন ধরে জমে উঠছিল। যুব সমাজের সেই ক্ষোভই শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনের রূপ নেয়। বহিরাগত শক্তি হয়তো পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছে, কিন্তু আগুন জ্বলছিল ভেতর থেকেই।
সেনার হাতে ক্ষমতা
ওলির পদত্যাগের পর আনুষ্ঠানিকভাবে শাসনভার নেয় সেনাবাহিনী। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশজুড়ে চলছে সেনা টহল। কিন্তু বিক্ষোভ থামার লক্ষণ নেই। বহিরাগত শক্তির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আর নেপালের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা মিলেমিশে দেশটিকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
👉 নেপালের সংকট তাই এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নয়; দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতারও প্রতিচ্ছবি।