বিনোদন ডেস্ক: লোকসংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, লালনগীতি গানের অন্যতম প্রধান কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি স্বামী ও চার সন্তান রেখে গেছেন।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন এই বরেণ্য শিল্পী। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের পাশাপাশি সম্প্রতি শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। গত সপ্তাহে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার জন্য রাখা হবে ফরিদা পারভীনের মরদেহ। বেলা ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নেওয়া হবে কুষ্টিয়ায়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে কুষ্টিয়া পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
শিল্পী জীবনের শুরু
১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন ফরিদা পারভীন। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে বিভিন্ন জেলায়। স্কুলজীবন শুরু হয় মাগুরায়, পরে কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং স্নাতক সম্পন্ন করেন।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে, ১৯৬৮ সালে তিনি পেশাদার সংগীতজীবন শুরু করেন। নজরুল ও আধুনিক গান দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশন করেই তিনি খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেন। গানের প্রাথমিক তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে।
লালনের বাণী ছড়িয়ে বিশ্বমঞ্চে
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান নতুন মাত্রা পায়। তিনি লালনের বাণী ও সুরকে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেন। জাপান, সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে লালনগীতি পরিবেশন করে তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক অনন্য দূত।
‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ কিংবা ‘নিন্দার কাঁটা’—এসব গান তার কণ্ঠে কালজয়ী হয়ে ওঠে।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তিনি জাপানের মর্যাদাপূর্ণ ‘ফুকুওয়াকা পুরস্কার’ লাভ করেন।
এক যুগের অবসান
বাংলাদেশের লোকসংগীত জগতে ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে নেমে এসেছে গভীর শোক। তার কণ্ঠ, তার পরিবেশনা এবং লালনচর্চার অবদান আগামী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
কুষ্টিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে যে শিল্পী লালনের বাণীকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তার মৃত্যুতে লোকসংগীত অঙ্গন হারালো এক অমূল্য সম্পদ। ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে বাংলা লোকসংগীতে যেন একটি যুগের অবসান ঘটল।