শ্রাবণী চ্যাটার্জি:
“বাদল-রাতে ডাকিলে ‘পিয়া পিয়া পাপিয়া’/ বেদনায় ভ’রে ওঠে নাকি রে কাহারো হিয়া”, “পিয়া গেছে কবে পরদেশ পিউ কাঁহা ডাকে পাপিয়া” অথবা, “চোখ গেল পাখি রে…” – একটা পাখির কণ্ঠস্বর, তার আবেদনকে কত ভাবে গানের মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব, শুধুমাত্র এই নজরুলসংগীতগুলি তার প্রমাণ। যাঁরা শুনেছেন, সহমত হবেন। কিছু কিছু পাখি বিশেষ ভঙ্গিতে ডাকে। এককালে পাখির ডাক শুনে, তার নামকরণ করতো বাঙালিরা। ‘এক ডাকে’ পাখি চিনতে পারতো। বর্তমান প্রজন্ম তার কতটুকুই বা জানলো! এখন আমাদের না আছে সেই মন, না আছে পরিবেশ!

বিভিন্ন পাখির ডাককে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তরজমা করা হয়। ডাকের তরজমা অনুসারেই বাংলাতে পাপিয়ার চলতি নাম “চোখ গেল”, আর হিন্দিতে “পিউ-কাঁহা”। মূলত বিরহের সঙ্গে তুলনা হয় এই পাখির ডাককে।
Common Hawk-Cuckoo বা পাপিয়া পাখি সারা বাংলাতে দেখতে পাওয়া গেলেও অনেক গবেষকের মতে, এই পাখি হুগলি জেলায় স্থায়ী বাসিন্দা। কোকিলের মতই এর ডাক বাংলাতে অত্যন্ত পরিচিত। শীতের শেষ থেকেই এদের তীব্র ডাক জেলার গ্রামাঞ্চল এমনকি শহরাঞ্চলেও একটু গাছপালা ঢাকা এলাকাতে প্রায়ই শোনা যায়। ভারতবর্ষে বিভিন্ন পাখির ডাককে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তরজমা করা হয়। ডাকের তরজমা অনুসারেই বাংলাতে পাপিয়ার চলতি নাম “চোখ গেল”, আর হিন্দিতে “পিউ-কাঁহা”। মূলত বিরহের সঙ্গে তুলনা হয় এই পাখির ডাককে।
বেশ উঁচু স্বরে ও তীব্রতায় ডাকটি শুরু হয়ে বারবার আগের থেকে উঁচু স্বরে ও তীব্রতায় পুনরাবৃত্তি হতে হতে (প্রায় পাঁচ-ছয় বার) একটি নির্দিষ্ট চরম উচ্চতায় পৌঁছে হঠাৎ করে থেমে যায়। ক্ষণিক স্তব্ধতার পরেই আবার শুরু হয় ডাক। উন্মাদের মতো স্তরে স্তরে বাড়তে থাকে ডাকের তীব্রতা। একটানা ডাকতে থাকলে কান-মাথা ঝিম ঝিম করে, তাই বোধহয় একে Brain Fever Bird বলে। এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে পড়বে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির একটি দৃশ্য। যেখানে এক নাগাড়ে “চোখ গেল, চোখ গেল” ডাক শুনে নায়িকা গাইছে “যা যা বেহায়া পাখি, যা-না, কেউ করেনি মানা”। এ পাখি নিয়ে ছড়া, কবিতা, গান-গল্প অনেক আছে।
পাপিয়ার শরীরের ওপরের অংশ –মাথা, পিঠ, ডানা ছাই-ছাই রঙের। গলা, বুক ও পেট সাদাটে। তাতে বাদামী রঙের ডোরা কাটা থাকে। লেজ লম্বা ও চওড়া। লেজের ওপর আড়াআড়ি ভাবে চওড়া কালচে ছাই রঙের ব্যান্ডের মতো দাগ থাকে। বসে থাকা অবস্থায় দূর থেকে অনেক সময়ই একে বাজ পাখির মতো দেখতে লাগে। এদের চোখ হলদে, চোখের মণি কালো। চোখের চারপাশে হলুদ রঙের মোটা গোলাকার দাগ দেখা যায়। অপরিণতবয়স্ক পাপিয়ার ক্ষেত্রে গলা, বুক ও পেটের ওপর খয়েরি ডোরা অনেক কম থাকে এবং শরীরের নিচের অংশ অনেক বেশি সাদাটে লাগে।

বসন্তের সময়টুকু বাদ দিলে সারাবছর এরা এতটাই চুপচাপ হয়ে যায় যে বছরের অন্য সময় এদেরকে চট করে লক্ষ করা যায় না। তাই অনেক সময়ই অনেক এলাকায় এদেরকে শীতকালীন পরিযায়ী বলে ধরা হয়।
শুঁয়োপোকা জাতীয় পোকা বা বিভিন্ন লার্ভা এদের সবথেকে প্রিয় খাবার। তবে অন্যান্য পোকা-মাকড় এবং ‘বেরি’ জাতীয় ফলও এরা খেয়ে থাকে। ডিম-পাড়ার ক্ষেত্রে এরা কোকিলদের মতোই পরাশ্রয়ী। তবে, এক্ষেত্রে পাপিয়াদের ‘ন্যাচারাল হোস্ট’ কাক নয়, বিভিন্ন প্রজাতির ছাতারে পাখি (Turdoides Babblers)। এদের প্রজননের সময় সাধারণত মার্চ থেকে জুন। তবে বিভিন্ন এলাকায় এদের ‘ন্যাচারাল হোস্ট’ ছাতারে পাখিদের প্রজননের সময়ের আগুপিছুর ওপর এদের প্রজননের সময় আগে-পিছে হয়ে থাকে।
বসন্তের সময়টুকু বাদ দিলে সারাবছর এরা এতটাই চুপচাপ হয়ে যায় যে বছরের অন্য সময় এদেরকে চট করে লক্ষ করা যায় না। তাই অনেক সময়ই অনেক এলাকায় এদেরকে শীতকালীন পরিযায়ী বলে ধরা হয়। বসন্তের প্রজননের সময় বাদ দিলে বছরের বাকি সময় এরা সাধারণত ঘন গাছওয়ালা কোনও এলাকাই বেশি পছন্দ করে। শীতের শেষ থেকে হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত উঁচু পাতাঝরা গাছের ন্যাড়া ডালে এদেরকে বসে থাকতে দেখা যায়। চুঁচুড়া শহর থেকে পশ্চিমে তারকেশ্বর পর্যন্ত সংযোগকারী বাস রাস্তার এবং মগরা থেকে আকনা, সুলতানগাছা, গুড়াপ-ভাস্তারা হয়ে দশঘড়া পর্যন্ত সংযোগকারী বাস রাস্তার দু-পাশের গাছে, টেলিগ্রাফের বা কেবললাইনের তারে এই সময় এদের খুব দেখা যায়।










