বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: দেশের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী সংগঠন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই)র আসন্ন নির্বাচন ঘিরে এবার ভিন্ন এক আবহ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অঘোষিত প্রভাববলয়ের কারণে যেখানে প্রতিযোগিতামূলক ভোটের সুযোগ ছিল না, সেখানে এবার বহু বছর পর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে এ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যবসায়ী সমাজে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।
ঐতিহ্যের সংগঠন, নতুন প্রেক্ষাপট
১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চিটাগাং চেম্বার দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীর ব্যবসায়ী স্বার্থরক্ষার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। আমদানি-রপ্তানিনির্ভর চট্টগ্রামের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নীতি-সহায়তা, বন্দর ব্যবস্থাপনা এবং শিল্প-বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। তবে গত কয়েক দশকে নেতৃত্বের একচেটিয়া আধিপত্য, নিষ্ক্রিয়তা এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় সংগঠনটির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে সেই দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্য ভাঙার পর থেকে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। এবার প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের সুযোগ পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বলছেন—এটি শুধু নেতৃত্ব পরিবর্তন নয়, বরং চেম্বারের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের এক অনন্য সুযোগ।
তিন প্যানেলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
রবিবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে অন্তত তিনটি প্যানেল এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী লড়াইয়ে নামায় নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা বেড়েছে। এর মধ্যে শিল্পপতি মো. আমিরুল হকের নেতৃত্বে ‘ওয়ান টিম’, প্রাক্তন সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নুরুল হকের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রামের সচেতন ব্যবসায়ী সমাজ’ এবং আমজাদ হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি প্যানেল ভোটযুদ্ধে শামিল হয়েছে।
চারটি ক্যাটাগরিতে এবার মোট ৭১ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ২৪টি পরিচালক পদে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অর্ডিনারি গ্রুপে ১২টি পদে ৪৮ প্রার্থী এবং অ্যাসোসিয়েট গ্রুপে ৬টি পদে ১৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। টাউন ও ট্রেড গ্রুপের ছয়টি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা
চেম্বারের আসন্ন নির্বাচনকে ব্যবসায়ীরা কেবল আনুষ্ঠানিক ভোট প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখছেন না। বরং তাঁদের দৃষ্টিতে এটি চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি মোড় ঘোরানো সময়। ব্যবসায়ী মহল মনে করছে, নির্বাচিত নেতৃত্ব যদি সরকারের সঙ্গে কার্যকর সংলাপ গড়ে তুলতে পারে তবে বন্দর জটিলতা, কাস্টমস হয়রানি এবং মহাসড়কে অযৌক্তিক স্কেল বসানোসহ নানা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
শিল্পপতি আমিরুল হক বলেন, “আমাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত চেম্বার গড়ে তোলা। আমরা চাই বে-টার্মিনালের দ্রুত বাস্তবায়ন, কাস্টমসে হয়রানি বন্ধ এবং ব্যবসায়ীদের জন্য বৈষম্যমুক্ত পরিবেশ।”
অন্যদিকে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আশা করছেন, নতুন নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিজিএমইএর এক সাবেক পরিচালক বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর যদি দক্ষভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে দেশের রপ্তানি খাত নতুন গতি পাবে।”
রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া
যদিও অনেক প্রার্থী নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ দাবি করছেন, তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচন থেকে রাজনীতির প্রভাব পুরোপুরি দূরে রাখা কঠিন। রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ উদ্যোক্তারা এখানে বিভিন্নভাবে যুক্ত আছেন। তবে ব্যবসায়ী সমাজ এখন একটি স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন দেখতে চায়।
ভোটের দিন সামনে
মনোনয়ন যাচাই হবে ২৩ সেপ্টেম্বর, বৈধ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ২৫ সেপ্টেম্বর এবং চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবে ৮ অক্টোবর। আগামী ১ নভেম্বর চট্টগ্রামের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বহু প্রতীক্ষার পর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ভোটে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত। তাঁদের প্রত্যাশা—নতুন নেতৃত্ব চেম্বারের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করবে, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাবে এবং চট্টগ্রাম তথা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে।