কামরুল ইসলাম: বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো ও আবাসন খাতের সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিমেন্ট শিল্পের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্লিংকার ও সিমেন্টের দামের অস্থিরতা, অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা, এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণের চ্যালেঞ্জের কারণে শিল্পখাতটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক চাহিদা ও বাজার প্রবণতা
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক সিমেন্ট ও ক্লিংকার বাজারের আকার দাঁড়াবে প্রায় ৪১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালের ৩৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। শুধু ক্লিংকার বাজারই ২০২৪ সালের ২২.৬৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩১.৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকায় চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। অপরদিকে চীন, ইউরোপ ও তুরস্কে উৎপাদন অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ায় বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে।
দাম ও রপ্তানি পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ক্লিংকারের FOB (Free on Board) দাম টনপ্রতি ৩৮–৩৯ ডলার এবং সিমেন্ট টনপ্রতি প্রায় ৪৬ ডলার। পাকিস্তানি রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগেও ক্লিংকারের দাম টনপ্রতি ২৮ ডলারে নেমে গিয়েছিল, যা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছিল না।
গ্লোবাল বাজারে ক্লিংকার উৎপাদনের প্রকৃত খরচ গড়ে প্রতি টন ১৬০ ডলার হিসেবে ধরা হয়, যদিও জ্বালানি ও কাঁচামালের মূল্য ভেদে এ খরচ অনেক ওঠানামা করে। ফলে উৎপাদনকারীরা এখন উচ্চমূল্যের বাজারে রপ্তানির সুযোগ নিতে চাইছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দিকে।
আঞ্চলিক চিত্র
চীন: ২০২৫ সালের আগস্টে চীনের সিমেন্ট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৮ মিলিয়ন টন, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.২ শতাংশ কম। রিয়েল এস্টেট খাতের মন্দা এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হ্রাস এর প্রধান কারণ।
ভারত: ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের সিমেন্ট উৎপাদন বেড়েছে ৯ শতাংশ, একইসঙ্গে ৫০ কেজি ব্যাগের দামও গড়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। বাজেট ও অবকাঠামো প্রকল্প চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ইউরোপ: পরিবেশগত নিয়মকানুনের চাপ বাড়লেও, ২০২৫ সাল নাগাদ ইউরোপের বাজারে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস।
রাশিয়া: চলতি বছরে দেশটিতে সিমেন্টের চাহিদা ১৩–১৫ শতাংশ কমতে পারে।
আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য: দ্রুত নগরায়ণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে এ অঞ্চলে চাহিদা বাড়ছে। তবে বিদ্যুৎ ও পরিবহন অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পরিবেশ ও প্রযুক্তি
সিমেন্ট শিল্প কার্বন নির্গমনের জন্য বিশ্বব্যাপী অন্যতম দায়ী খাত। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর জ্বালানি ব্যবহার এবং লাইমস্টোন থেকে সরাসরি CO₂ নির্গমন হয়। এর ফলে অনেক দেশ কার্বন নির্গমন হ্রাসে নতুন নীতি গ্রহণ করছে।
আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোও বিকল্প জ্বালানি, ব্লেন্ডেড সিমেন্ট, CCUS (Carbon Capture, Utilization and Storage) প্রযুক্তি, এমনকি নতুন পদ্ধতিতে ক্লিংকার মাইক্রোনাইজিংয়ের মতো উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছে। যেমন, মেক্সিকোর বহুজাতিক কোম্পানি Cemex এ ধরনের প্রযুক্তি চালু করেছে, যা খরচ ও নির্গমন কমাতে সাহায্য করবে।
চ্যালেঞ্জ
- অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা (Overcapacity)
- জ্বালানি ও কাঁচামালের উচ্চমূল্য
- কঠোর পরিবেশ আইন
- পরিবহন ও লজিস্টিক ব্যয়
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি উচ্চমূল্য আগামী বছরগুলোতে স্থিতিশীল রূপ পেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলে বাড়তি চাহিদা বিশ্ববাজারে রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
একই সঙ্গে সবুজ প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট উৎপাদনে বিনিয়োগ শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।