খায়রুল বাশার বাহার ইস্যুতে বড় প্রশ্ন
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট সম্প্রতি বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কসের স্বত্বাধিকারী খায়রুল বাশার বাহারের ৪২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে। বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার সুযোগের প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতারণার প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁর নামে থাকা ১২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ জমি আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়।
বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন ও প্রতারণার ফাঁদ
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেতে চায়। এই চাহিদাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য এডুকেশন কনসালটেন্সি। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠান যে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে, তা নয়। অনেকেই ভুয়া অফার, জাল কাগজপত্র বা ‘সহজে ভর্তি ও ভিসা’ পাওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
বাহারের কেসটি এমন একটি বড় উদাহরণ। তিনি নিজেকে শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ী হিসেবে উপস্থাপন করলেও সিআইডি তাঁকে চিহ্নিত করেছে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের মূল হোতা হিসেবে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে টোপ বানিয়ে তিনি যে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন, তা এখন একে একে বেরিয়ে আসছে।
শিক্ষা খাতে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট
এমন প্রতারণা শিক্ষার্থীদের শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং তাদের মানসিক স্বপ্নকেও ভেঙে দিচ্ছে। অনেকে জীবনের সঞ্চিত অর্থ, জমি বিক্রি কিংবা ঋণ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনার পথে বিনিয়োগ করেন। প্রতারণার শিকার হওয়ার পর তারা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পরিবারের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে আসা আবেদনগুলোতে আরও কড়াকড়ি নীতি গ্রহণ করতে পারে। ফলে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আগের অভিজ্ঞতা ও ধারাবাহিকতা
শিক্ষার্থী প্রতারণার এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিক শিক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতারণার দায়ে ধরা পড়েছে। বিশেষত ঢাকায় গড়ে ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠান ভিসার নামে ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি, ভর্তি প্রক্রিয়ায় অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে যায়, শাস্তি হয় না, আর এ সুযোগে নতুন করে প্রতারণার চক্র মাথাচাড়া দেয়।
কীভাবে রোধ সম্ভব?
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে সরকারি নজরদারি ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বাংলাদেশে কার্যরত শিক্ষা কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সের আওতায় আনা দরকার। তাদের কার্যক্রমের নিয়মিত অডিট করা উচিত। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে তারা অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফাঁদে না পড়ে।
খায়রুল বাশার বাহারের ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে—শিক্ষা খাতের নামে প্রতারণা এখন একটি লাভজনক ‘ইন্ডাস্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসবে তখনই, যখন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনগত কাঠামোর মধ্যে আনা হবে এবং শিক্ষার্থীরা নিজেরাও সচেতন হবেন।
তুলনামূলক চার্ট: বিদেশে পড়াশোনা সংক্রান্ত প্রতারণা
দেশ/অঞ্চল | প্রতারণার সাধারণ ধরন | ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী (আনুমানিক) | উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ |
---|---|---|---|
বাংলাদেশ | ভুয়া অফার লেটার, ভিসার নামে টাকা আত্মসাৎ, ভুয়া কনসালটেন্সি | কয়েক হাজার (প্রতিবছর) | সিআইডি অভিযান, সম্পদ ক্রোক, কিছু গ্রেপ্তার |
ভারত | ভিসা প্রমিজ, জাল অ্যাডমিশন লেটার, এজেন্সি কমিশন প্রতারণা | কয়েক হাজার (মূলত পাঞ্জাব ও হায়দরাবাদে) | কেন্দ্রীয় ভিসা ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা চালু |
নেপাল | জাল কলেজে ভর্তি, টিউশন ফি আত্মসাৎ | কয়েক শত | শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স ব্যবস্থা |
নাইজেরিয়া | ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিগ্রি বিক্রি | কয়েক হাজার | ফেডারেল সরকার ‘ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় তালিকা’ প্রকাশ |
চীন | বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভুয়া স্কলারশিপ প্রলোভন | অল্পসংখ্যক (মূলত আফ্রিকা থেকে আগত) | বিশ্ববিদ্যালয় তালিকা সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ |
যুক্তরাষ্ট্র/কানাডা | ভুয়া কলেজ বা ভুয়া অ্যাডমিশন কনসালটেন্ট | কয়েক হাজার (অভিবাসী শিক্ষার্থী) | কড়া ইমিগ্রেশন স্ক্রুটিনি, ভিসা বাতিলের ব্যবস্থা |