বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ: শরতের নরম হাওয়ায় শীতের আগমনী সুর বাজতে না বাজতেই জেগে উঠেছে সিরাজগঞ্জের চলনবিল। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে হঠাৎই দেখা মিলছে রঙিন পালকের মেলা—ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে অতিথি পাখির দল। আকাশজুড়ে তাদের ডানার নাচন, বিলের জলে প্রতিফলিত রঙিন আভা—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত কবিতার দৃশ্য।
প্রতিবছরের মতো এবারও দূর উত্তর সাইবেরিয়া ও তীব্র শীতপ্রবণ দেশগুলো থেকে হাজারো পরিযায়ী পাখি আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের উষ্ণ ও জীবনময় এই বিলে। যেখানে রয়েছে খাদ্যের প্রাচুর্য, শান্ত জলের আহ্বান, আর মানুষের মায়াভরা উপস্থিতি।
তাড়াশ উপজেলার বিস্তীর্ণ চলনবিলের বুকজুড়ে এখন দেখা যাচ্ছে বক, ইটালি, শার্লি, পিয়াজ খেকো, ত্রিশুল, নারুলিয়া, ফেফি, কাঁদোখোচা, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, রাতচোরা ও শামকৈলসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখির দল। তাদের ডানায় ভেসে আসা সুরে জেগে উঠেছে নিস্তব্ধ বিলাঞ্চল।
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, পানি পুরোপুরি না শুকালেও যমুনা চরের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যেই পাখির আনাগোনা শুরু হয়েছে। এই বিলের বুকজুড়ে একসময় ১৪টি নদী ও ২২টি ছোট-বড় বিল ছিল, যার অনেকগুলো আজ বিলীন হয়ে গেছে। তবুও প্রকৃতি যেন হার মানতে জানে না—প্রতিবারের মতো এবারও ফিরে এসেছে জীবন, ফিরে এসেছে ডানার শব্দ।
দর্শনার্থীরাও ভিড় জমাচ্ছেন প্রতিদিন। কেউ দূর শহর থেকে আসছেন ক্যামেরা হাতে, কেউ বা শুধু প্রকৃতির রঙে মিশে একটুখানি নিঃশ্বাস নিতে। শিশুরা হাততালি দিয়ে উড়তে থাকা পাখিদের দেখে মুগ্ধ হয়, আর জেলেরা নৌকা বেয়ে বলে ওঠে, “এই দৃশ্যটাই তো আমাদের শীতের আনন্দ।”
তবে আনন্দের এই মেলায় ছায়া ফেলেছে কিছু অসাধু শিকারির দৌরাত্ম্য। চলনবিলের বিভিন্ন প্রান্তে জাল ও খাঁচা ফেলে নিয়মিতভাবে ধরা হচ্ছে পাখি। স্থানীয় হাটে দেখা গেছে, বক বিক্রি হচ্ছে একশ টাকায়, রাতচোরা ৪৫০ টাকায় জোড়া, বালিহাঁস ৬০০ টাকায়। এসব বিক্রির পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে একেকটি প্রাণ, নিঃশেষ হচ্ছে একেকটি প্রজাতি।
বেসরকারি সংগঠন ‘স্বাধীন জীবন’-এর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক নাসিম বলেন, “এই পাখিরা শুধু সৌন্দর্য নয়, আমাদের কৃষিজ অর্থনীতিরও বন্ধু। তারা পোকামাকড় খেয়ে জমির ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু শিকার বন্ধ না হলে একদিন আর এই সুর, এই সৌন্দর্য কিছুই থাকবে না।”
তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শর্মিষ্ঠা সেন গুপ্তের ভাষায়, “অতিথি পাখি শুধু পরিবেশ নয়, কৃষিরও আশীর্বাদ। তারা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে কীটনাশকের ব্যবহার কমায়, ফলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা রক্ষা পায়।”
চলনবিল আজ তাই শুধু পাখিদের আশ্রয় নয়, এক প্রতিরোধের প্রতীকও প্রকৃতি টিকে থাকার লড়াই করছে নিজের সৌন্দর্য দিয়েই। যতদিন আকাশে তাদের ডানার শব্দ শোনা যাবে, ততদিন মানবতার হৃদয়েও বাজবে জীবনের উচ্ছ্বাস।