আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রসায়নে নোবেল পুরস্কার ২০২৫ অর্জন করেছেন তিনজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী — জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া (Kyoto University), অস্ট্রেলিয়ার রিচার্ড রবসন (University of Melbourne) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওমর এম. ইয়াঘি (University of California, Berkeley)। বাংলাদেশ সময় বুধবার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ বছরের রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স।
“ধাতব-জৈব কাঠামো (Metal-Organic Frameworks, MOFs)” উদ্ভাবনের জন্য তাদের এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস। এই কাঠামোগুলোকে বলা হচ্ছে “রাসায়নিকের জন্য নতুন ঘর” — যেখানে অণুস্তরে তৈরি ছিদ্রযুক্ত স্থানে গ্যাস বা অন্যান্য রাসায়নিক প্রবাহিত হতে পারে।
এই নতুন প্রজন্মের অণু-নকশা এমন সব কাজে ব্যবহারযোগ্য যেখানে প্রকৃতির জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব— যেমন মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণ, কার্বন ডাই–অক্সাইড সংগ্রহ, বিষাক্ত গ্যাস সংরক্ষণ, কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।
অণু-স্থাপত্যের নতুন দিগন্ত
তিন বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত এই ধাতব-জৈব কাঠামোর মূল ধারণা হলো — ধাতব আয়নগুলোকে “কোণার পাথর” হিসেবে ব্যবহার করে, দীর্ঘ জৈব (কার্বন-ভিত্তিক) অণুর মাধ্যমে তাদের সংযুক্ত করা। ফলে তৈরি হয় এমন স্ফটিক (crystal) কাঠামো, যার ভেতরে বিশাল ছিদ্র বা ফাঁকা স্থান থাকে।
এই ছিদ্রযুক্ত বস্তুগুলোকে বলা হয় Metal-Organic Frameworks (MOF)। রাসায়নিকরা বিভিন্ন ধরনের ধাতু ও জৈব অণু ব্যবহার করে MOF-এর গঠন পরিবর্তন করে নির্দিষ্ট পদার্থ ধরে রাখার বা বিক্রিয়া ঘটানোর মতো বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পারেন। অনেক MOF বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবেও কাজ করতে পারে।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান হেইনার লিঙ্কে বলেন, “ধাতব-জৈব কাঠামো রসায়নে এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এটি কাস্টমাইজড উপাদান তৈরি ও নতুন কার্যকারিতা বিকাশের এক অভূতপূর্ব ক্ষেত্র এনে দিয়েছে।”
সূচনা ১৯৮৯ সালে
এই আবিষ্কারের সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে, যখন রিচার্ড রবসন নতুনভাবে ধাতব পরমাণুর বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। তিনি ধনাত্মক তামার আয়নকে (copper ion) চার বাহুযুক্ত এক জৈব অণুর সঙ্গে যুক্ত করেন, যার প্রতিটি প্রান্ত তামার সঙ্গে আকৃষ্ট হতো।
ফলাফল ছিল এক সুন্দরভাবে বিন্যস্ত, ছিদ্রযুক্ত স্ফটিক — হীরার মতো দেখতে, কিন্তু ভেতরে অগণিত ফাঁকা ঘর। যদিও তা ছিল অস্থিতিশীল। পরবর্তীতে সুসুমু কিতাগাওয়া ও ওমর ইয়াঘি ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে একাধিক যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে এই প্রযুক্তিকে মজবুত ভিত্তি দেন।
কিতাগাওয়া দেখান, গ্যাস MOF কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ ও বাহির হতে পারে, আর ইয়াঘি তৈরি করেন অত্যন্ত স্থিতিশীল MOF যা পরে ‘রেশনাল ডিজাইন’-এর মাধ্যমে পরিবর্তন করা সম্ভব হয় — ফলে কাঙ্ক্ষিত নতুন বৈশিষ্ট্য তৈরি করা যায়।
তাদের এই কাজের পর সারা বিশ্বের রসায়নবিদরা এখন পর্যন্ত দশ হাজারেরও বেশি ভিন্নধর্মী MOF তৈরি করেছেন। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, পানিতে PFAS দূষণ অপসারণ, পরিবেশে থাকা ওষুধের অবশিষ্টাংশ ভাঙন বা কার্বন সংরক্ষণের মতো মানবজাতির বড় চ্যালেঞ্জ সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পুরস্কার ও প্রাপ্তির তথ্য
এই বছরের রসায়নে নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা, যা তিনজন বিজয়ীর মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে।
বিজয়ীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
সুসুমু কিতাগাওয়া, জন্ম ১৯৫১, কিয়োটো, জাপান; পিএইচডি ১৯৭৯, Kyoto University; বর্তমানে অধ্যাপক, Kyoto University।
রিচার্ড রবসন, জন্ম ১৯৩৭, গ্লাসবার্ন, যুক্তরাজ্য; পিএইচডি ১৯৬২, University of Oxford; অধ্যাপক, University of Melbourne, অস্ট্রেলিয়া।
ওমর এম. ইয়াঘি, জন্ম ১৯৬৫, আম্মান, জর্ডান; পিএইচডি ১৯৯০, University of Illinois Urbana-Champaign; অধ্যাপক, University of California, Berkeley, যুক্তরাষ্ট্র।