Home First Lead বাণিজ্যযুদ্ধের ফাঁদে যুক্তরাষ্ট্র, সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ

বাণিজ্যযুদ্ধের ফাঁদে যুক্তরাষ্ট্র, সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ

সয়াবিন আমদানি রেকর্ড বৃদ্ধি; বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সহায়ক হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা:
বিশ্ব অর্থনীতির দুই মহাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাতে অনিশ্চয়তা তৈরি করলেও, বাংলাদেশ বরং এর কিছু ইতিবাচক সুফল পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন বাজারে চীনের অনুপস্থিতি এখন বাংলাদেশের আমদানিকারকদের জন্য এক “সুবর্ণ সুযোগ” তৈরি করেছে। কম দামে উন্নতমানের সয়াবিন সংগ্রহের সুযোগ পেয়ে দেশের তেল, খাদ্য ও পশুখাদ্য শিল্প নতুন এক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে পৌঁছেছে।
চীনের সরে যাওয়ায় মার্কিন কৃষকদের বিপাকে, কিন্তু বাংলাদেশের লাভ

চীন বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন আমদানিকারক। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন আমদানিতে ২০ শতাংশ প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে চীন কার্যত মার্কিন সয়াবিন কেনা বন্ধ করে দেয়।

ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সয়াবিন রপ্তানির অর্ধেকেরও বেশি যেত চীনে—প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। চীনের সেই চাহিদা এক লহমায় হারিয়ে যাওয়ায় মার্কিন কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

কিন্তু একই সঙ্গে তৈরি হয় নতুন এক পরিস্থিতি—অতিরিক্ত মজুত, ফলে দাম কমে যাওয়া। আর সেই অতিরিক্ত সরবরাহের দিকেই নজর দিয়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজার।

বাংলাদেশের আমদানিতে রেকর্ড বৃদ্ধি

রয়টার্সের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে সয়াবিন রপ্তানি এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে এখন ৪ লাখ টনের কাছাকাছি।
আগে যেখানে বাংলাদেশের সয়াবিন আমদানির বড় অংশ আসত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে, সেখানে এখন যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে উঠছে প্রধান উৎস।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. তসলিম শাহরিয়ার বলেন, “চীনের আমদানি বন্ধ হওয়ার পর মার্কিন সয়াবিনের দাম কমেছে। এখন প্রতি টনে ৪০ ডলার পর্যন্ত দামের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান সয়াবিনের তুলনায়।”

তিনি আরও জানান, আগে যেখানে এমজিআই তাদের ৬০ শতাংশ সয়াবিন আমদানি করত ব্রাজিল থেকে, এখন তা কমে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, বাকি ৮০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
“এই দামের সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হলে বাংলাদেশি শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যয়ও কমবে,” যোগ করেন তিনি।

মানের দিক থেকেও এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র

ডেল্টা অ্যাগ্রোফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “মার্কিন সয়াবিনের মান অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক উন্নত। দানার তেল ধারণ ক্ষমতা বেশি, আর অপদ্রব্য কম।”
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন টনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪৭০ ডলারে, যেখানে ব্রাজিলিয়ান সয়াবিনের দাম প্রায় ৪৯০ ডলার।
“২০–৩০ ডলারের পার্থক্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিশাল সুবিধা তৈরি করে,” বলেন আমিরুল।

তার মতে, শুধু দাম নয়, গুণগত মান ও নিয়মিত সরবরাহের নিশ্চয়তা বাংলাদেশের ক্রাশিং শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসেও ভূমিকা রাখতে পারে

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৮.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু আমদানি করে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের মতো।
এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিনসহ কৃষিপণ্য আমদানি বাড়ায় এই ঘাটতি কিছুটা হলেও কমতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

আমিরুল হক বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আগ্রহী ছিল, ফলে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাসকৃত শুল্ক প্রযোজ্য করা হয়েছে। এটি উভয় দেশের জন্যই ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”

সংখ্যায় অগ্রগতি

যুক্তরাষ্ট্র সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের (USSEC) বাংলাদেশ টিম লিড খবিবুর রহমান জানান, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ৪ লাখ টন সয়াবিন আমদানি করেছে—যা আগের দুই মাসের দ্বিগুণ।
শুধু সেপ্টেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১ লাখ ১৪ হাজার টন সয়াবিন, যা মোট আমদানির ৮৭.১১ শতাংশ।

“জুলাই মাসে মার্কিন সয়াবিনের অংশ ছিল ৪৫ শতাংশের মতো, এখন সেই হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে,” বলেন তিনি।

USSEC-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ বিপণন বছরে বাংলাদেশের সয়াবিন ক্রাশিং ৯.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ লাখ টনে পৌঁছাবে। এটি দেশের খাদ্যতেল ও পশুখাদ্য শিল্পে নতুন রেকর্ড স্থাপন করতে পারে।

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

অর্থনীতিবিদদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম দামে সয়াবিন আমদানি বাংলাদেশের খাদ্যশিল্প, পশুপালন ও ভোজ্যতেল বাজারে ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে।
এতে দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির চাপও কিছুটা প্রশমিত হতে পারে, কারণ সয়াবিন তেল বাংলাদেশের ভোজ্যতেল বাজারের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,
“যে কোনো দেশের জন্য এ ধরনের বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবর্তন সুযোগ হিসেবে আসে। এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো—বাংলাদেশ এই সুযোগ কতটা কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে পারে।”

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্ববাণিজ্যে যে অস্থিরতা তৈরি করেছে, তা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের “বাণিজ্যিক জানালা” খুলে দিয়েছে।
সস্তা ও উন্নতমানের সয়াবিন কাঁচামাল আমদানির ফলে দেশের খাদ্যশিল্প ও তেল উৎপাদন খরচ কমছে, পাশাপাশি মার্কিন বাজারের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কও নতুন মাত্রা পাচ্ছে।

যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে এটি কেবল স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক সুবিধা নয়—বরং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইনে একটি কৌশলগত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।