বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পোন্নয়নের ধারাকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সিমেন্ট শিল্প। প্রায় এক দশক ধরে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে-যেমন কাঁচামালের সরবরাহ সংকট, ডলারের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি এবং তীব্র প্রতিযোগিতা। দেশের ৩৫টির বেশি সক্রিয় সিমেন্ট কারখানা বছরে প্রায় ৭ কোটি টন উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে, যেখানে দেশীয় চাহিদা ৩.৫–৪ কোটি টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, শিল্পটি দ্বিগুণ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে, যা একদিকে সম্ভাবনার প্রতীক, অন্যদিকে ব্যবসায়িক চাপ বাড়াচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আমিরুল হক দেশের সিমেন্ট খাতের বর্তমান অবস্থা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি খোলামেলা সাক্ষাৎকারে জানালেন তাঁর মূল্যায়ন। তিনি শুধুমাত্র শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেননি, বরং কাঁচামাল ও জ্বালানির ব্যয়, অবকাঠামো উন্নয়নের চাহিদা, রপ্তানি সম্ভাবনা এবং শিল্পের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশগুলোও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সাক্ষাৎকারে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর থেকে স্পষ্ট হয় যে, সঠিক নীতি ও সরকারি সহায়তা থাকলে দেশের সিমেন্ট শিল্প আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে সক্ষম। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসা মোহাম্মদ আমিরুল হক আজ দেশের অন্যতম সফল শিল্পনেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি সিকম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস পিএলসির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত:
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পের বর্তমান অবস্থা আপনি কীভাবে দেখছেন?
আমিরুল হক: বর্তমানে দেশে সিমেন্ট শিল্প একটি পরিপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক খাতে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৩৫টি সক্রিয় কারখানা বছরে ৭ কোটি টনেরও বেশি উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে। অথচ দেশের চাহিদা সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ আমরা প্রায় দ্বিগুণ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছি। এই বাড়তি সক্ষমতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতীক হলেও অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ব্যবসাকে কঠিন করে তুলছে।
প্রশ্ন: কাঁচামাল ও জ্বালানির দামের উত্থান–পতন শিল্পে কী প্রভাব ফেলছে?
আমিরুল হক: সিমেন্ট শিল্প মূলত আমদানিনির্ভর। ক্লিংকার, জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ—সবই আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে, শুল্কও তুলনামূলক বেশি। একইসাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ গত কয়েক বছরে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কিন্তু বাজারে দাম সমন্বয় করা সবসময় সম্ভব হয় না। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়ছে।
প্রশ্ন: অবকাঠামো উন্নয়নে সিমেন্টের ব্যবহার কতটা বাড়ছে বলে মনে করেন?
আমিরুল হক: দেশের বড় প্রকল্পগুলো—মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সিমেন্টের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। এখনো চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে গভীর সমুদ্রবন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে। এগুলো ভবিষ্যতে সিমেন্ট চাহিদা আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমি মনে করি, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে দেশীয় সিমেন্ট শিল্পের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
প্রশ্ন: রপ্তানি সম্ভাবনা নিয়ে কী বলবেন?
আমিরুল হক: আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের কিছু অঞ্চলে সিমেন্ট রপ্তানি হচ্ছে। তবে পরিমাণ খুবই সীমিত। কারণ, পরিবহন খরচ ও প্রতিযোগিতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে সরকারের সহায়তা ও কর অবকাশ সুবিধা পেলে রপ্তানি বাজার প্রসারিত করা সম্ভব।
প্রশ্ন: শিল্পের টিকে থাকার জন্য আপনার কী সুপারিশ থাকবে?
আমিরুল হক: প্রথমত, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ও কর কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডলার সংকট নিরসনে শিল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তৃতীয়ত, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের খরচ স্থিতিশীল রাখতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে। সরকার–শিল্প–ব্যবসায়ী একসাথে কাজ করলে সিমেন্ট শিল্প দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে পারবে।
প্রশ্ন: সিমেন্ট শিল্পে ভবিষ্যতের প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
আমিরুল হক: সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিযোগিতা। উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামের ওঠানামা এবং অভ্যন্তরীণ জ্বালানি খরচ শিল্পকে চাপে রাখবে। তবে সঠিক নীতি সহায়তা পেলে বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্প শুধু টিকবেই না, আন্তর্জাতিক মানে অবস্থান তৈরি করবে।