Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য কুতুবদিয়া বাতিঘর: নোনাজলে জেগে থাকা আলোর টাওয়ার

কুতুবদিয়া বাতিঘর: নোনাজলে জেগে থাকা আলোর টাওয়ার

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কক্সবাজার: বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে দূর থেকে যে আলো ভেসে আসে, সেটিই কুতুবদিয়া বাতিঘর। নাবিকেরা একে বলে ‘সমুদ্রের চোখ’। গভীর রাতের অন্ধকারে, ঢেউয়ের গর্জনের মধ্যে এই আলোই পথ দেখায় চট্টগ্রামমুখী জাহাজকে। কিন্তু বাতিঘরটি শুধু নাবিকদের ভরসা নয়—এটি এক নিঃসঙ্গ প্রহরী, যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্রের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
অতীতের আলো

ব্রিটিশ আমলে, ১৮৪৬ সালে, যখন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ চলাচল শুরু হয়, তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কুতুবদিয়ায় বাতিঘর নির্মাণের। উদ্দেশ্য ছিল গভীর সমুদ্রপথে আসা জাহাজগুলোকে নিরাপদে তীরে পৌঁছে দেওয়া। ১৮৯২ সালে স্থাপন করা হয় ঘূর্ণায়মান আলো—তখন নারিকেল তেল জ্বালিয়ে আলোর উৎস তৈরি হতো। বাতিঘরটি ছিল প্রস্তর ও ইটের তৈরি, প্রায় ৪০ মিটার উঁচু, মাথায় গোল লণ্ঠন ঘর। দূর থেকে সেটি নাবিকদের কাছে ভাসত এক বিশাল দীপশিখার মতো।

পুরাতন বাতিঘর

কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেনি সেই পুরোনো বাতিঘর। ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এটি ধসে যায়। সময়ের স্রোতে বাতিঘরের ভগ্নাবশেষ ডুবে থাকে বালির নিচে—ভাটার সময় কখনো কখনো জেগে ওঠে, ঠিক যেন হারানো ইতিহাসের নিশান।

নতুন আলোর জন্ম

১৯৭২ সালে দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের উপকূলে নতুন বাতিঘর তৈরি হয়। এবার কাঠের জায়গায় ব্যবহৃত হয় কংক্রিট ও লোহার গঠন। এর উচ্চতা প্রায় ১২০ ফুট। প্রতি ১০ সেকেন্ডে সাদা আলো তিনবার ঝলকায়—গভীর রাতে সেটি যেন সমুদ্রের হৃদয়ে জ্বলে থাকা এক স্থির মোমবাতি।

এ বাতিঘর এখন আধুনিক যন্ত্রে চালিত, কিন্তু তার কাজ একই—আলো জ্বালিয়ে রাখা, পথহারা জাহাজকে দিকনির্দেশ দেওয়া, নাবিকদের মনে ভরসা জাগানো।

বাতাস, ঢেউ আর নোনাজলের গন্ধ

কুতুবদিয়া শুধু বাতিঘরের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি এক বিস্ময়কর দ্বীপ। চারপাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি, বিস্তীর্ণ বালুচর, বাতাসে নোনাজলের গন্ধ। সূর্য যখন ডোবে, তখন বাতিঘরের আলোকরশ্মি মিশে যায় লালচে আকাশের সঙ্গে—দেখতে লাগে যেন সমুদ্রের গলায় একটি দীপ্তিময় হার ঝুলছে।

বিকেলবেলা দ্বীপের মানুষরা জড়ো হয় বাতিঘরের পাদদেশে। কেউ মাছ ধরে, কেউ সমুদ্র দেখে, কেউ বা নিঃশব্দে বসে থাকে—ঠিক যেন বাতিঘরের মতোই, সময়ের প্রহরী হয়ে।

আর পর্যটকদের কাছে এটি এক বিস্ময়ের জায়গা। সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে বাতিঘরের দিকে তাকালে মনে হয়, এটি শুধু স্থাপনা নয়—এ যেন মানুষের আশা, টিকে থাকার প্রতীক।

পৌঁছানোর পথ

ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চকরিয়া পর্যন্ত বাসে যাওয়া যায়। সেখান থেকে মগনামা ঘাটে সিএনজিতে, তারপর নৌকায় পার হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ। নদীর জল পেরিয়ে যখন বাতিঘর চোখে পড়ে, মনে হয়—একটি গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়া গেল, যেখানে আলো ও জল একে অপরের সঙ্গে মিশে আছে।

কুতুবদিয়া বাতিঘর নিছক স্থাপনা নয়—এ এক চরিত্র। ইতিহাসের, সমুদ্রের, মানুষের নিঃসঙ্গতার। কখনো ঝড়, কখনো জোয়ারে ভেসে থেকেও সে জ্বলে আছে। কবি জীবনানন্দের মতো, সে যেন বলে চলে—“অন্ধকারে পথ হারানো মানুষদের জন্য আমি আলো জ্বালাই।”

বাতিঘরের আলো নিভে গেলে চট্টগ্রামের বন্দরের জাহাজও থেমে যায়। তাই হয়তো বলা যায়—যতদিন সমুদ্র আছে, ততদিন জেগে থাকবে কুতুবদিয়ার বাতিঘর, নোনাজলে ভাসমান এক অবিনশ্বর কবিতা হয়ে।