ছবি: এ আই
তারিক-উল-ইসলাম: ভারতের ইতিহাসে হায়দরাবাদ ছিল এক সময় সমৃদ্ধি, সংস্কৃতি ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। সেই রাজ্যের উত্তরাধিকার সূত্রে জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক রাজপুত্র, যাঁর নাম আজও কিংবদন্তির মতো উচ্চারিত হয়—মুকাররম জাহ। তিনি ছিলেন হায়দরাবাদের সপ্তম ও শেষ নিজাম মির ওসমান আলি খানের নাতি, যিনি একসময় বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই রাজবংশের ঐতিহ্য যেমন ছিল দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ, অমূল্য রত্ন ও শিল্প-সংস্কৃতিতে পূর্ণ, তেমনই ছিল প্রশাসনিক প্রজ্ঞা ও সামাজিক প্রভাবের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মুকাররম জাহের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর, হায়দরাবাদের নিজাম পরিবারের রাজকীয় আবাসে। তাঁর পিতা আজম জাহ ছিলেন প্রিন্স অব বেরা, আর মা দুড়রু শেহভার ছিলেন তুরস্কের শেষ খলিফা আবদুল মজিদ দ্বিতীয়ের কন্যা। ফলে মুকাররম জাহ ছিলেন দুই মহান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি ভারতের হায়দরাবাদ রাজ্য ও তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। এই ঐতিহাসিক সংমিশ্রণই তাঁকে ছোটবেলা থেকেই রাজকীয় সৌন্দর্য ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তোলে।

শিক্ষা জীবনের শুরু হয় ভারতের দুনস্কুলে, পরে লন্ডনের হারো ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। ইতিহাস ও প্রশাসনে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতি ও বিশ্বপরিসরের পরিবর্তনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ভারত তখন স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হচ্ছে, আর তাঁর মাতৃরাজ্য হায়দরাবাদ দাঁড়িয়ে আছে রাজকীয় স্বাধীনতার এক সন্ধিক্ষণে।

দাদু মির ওসমান আলি খানের মৃত্যুর পর ১৯৬৭ সালে মুকাররম জাহ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আসাফ জাহ সপ্তম’ উপাধি ধারণ করেন। তিনি হয়ে ওঠেন হায়দরাবাদের শেষ নিজাম। যদিও তখন হায়দরাবাদ আর কোনো স্বাধীন রাজ্য নয়, ভারতের অংশ হয়ে গেছে, তবুও ঐতিহ্যের দায় তাঁর কাঁধে ছিল। তিনি ছিলেন শুধু এক রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী নন, বরং এক ইতিহাসের রক্ষক, যিনি প্রাচীন ঐশ্বর্য ও আধুনিক সময়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তাঁর জীবনের শৈশব কেটেছে রাজকীয় চাকচিক্যে। ফলকনুমা প্যালেসের সোনালি দেয়াল, চৌমহল্লা প্যালেসের ঝাড়বাতির আলো, আর রাজকীয় সভার মহিমা—এই সবকিছু ছিল তাঁর বেড়ে ওঠার অংশ। কিন্তু এই ঐশ্বর্যের আড়ালেই শুরু হচ্ছিল এক পরিবর্তনের যুগ। ভারতের নতুন সংবিধান রাজপ্রথার অবসান ঘটাচ্ছে, এবং একে একে রাজারা হারাচ্ছেন তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা। মুকাররম জাহ ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারছিলেন, তাঁর জীবনের গৌরবময় উত্তরাধিকার আর আগের মতো থাকবে না।

তবে এই পর্বে তাঁকে ঘিরে ছিল উচ্চাশা ও প্রত্যাশা। রাজপরিবারের তরুণ উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো আধুনিক যুগে নিজাম রাজ্যের ঐতিহ্যকে নতুন আঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। কিন্তু সময়ের স্রোত অন্যদিকে বয়ে যায়।

মুকাররম জাহ ছিলেন একাধারে সংস্কৃতিপ্রেমী, রোমান্টিক ও সংবেদনশীল মানুষ। রাজনীতির কূটচালে তাঁর আগ্রহ ছিল কম, বরং শিল্প, স্থাপত্য ও রাজকীয় নান্দনিকতায় তিনি খুঁজে পেতেন নিজের শান্তি। তাঁর জীবনের প্রথম অধ্যায় তাই শুধুই এক রাজপুত্রের নয়, বরং এক ইতিহাসের সন্তান—যিনি ঐতিহ্যের ভার নিয়ে জন্মেছিলেন, কিন্তু যুগের পরিবর্তনে তাঁর রাজত্বের মানচিত্র হারিয়ে যেতে দেখেছেন।

এই প্রথম পর্বে তাঁর জন্ম ও উত্তরাধিকারের কাহিনি শেষ হয় এক প্রশ্নে, যে রাজকীয় ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেটি কি ভবিষ্যতের কঠোর বাস্তবতায় টিকে থাকতে পারবে?

দ্বিতীয় পর্বে থাকবে সেই গৌরবময় দিনগুলোর কাহিনি, যেখানে হায়দরাবাদের প্রাসাদে ঝলমল করত সোনার প্রাসাদ, হীরার মুকুট আর বিশ্বের ধনীতম রাজ্যের বিস্ময়কর ঐশ্বর্য।
(পরবর্তী পর্ব: “সোনার প্রাসাদের রাজপুত্র: ঐশ্বর্য ও বিলাসের দিনগুলো”)