শেরে বাংলা ও বরিশাল: ইতিহাসের আলেখ্য: পর্ব-১
অরূপ তালুকদার:
শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের পেছনে যেমন ছিল জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, তেমনি তাঁর শিক্ষাজীবন ও আইনজীবী হিসেবে পেশাগত অভিজ্ঞতাও তাঁকে গড়ে তোলে এক অসাধারণ নেতা হিসেবে। কলকাতার শিক্ষা ও আইনপেশায় উজ্জ্বল সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি তিনি বরিশালের শিকড়কে কখনও ভুলে যাননি। এভাবেই গড়ে ওঠে বরিশাল ও কলকাতার মধ্যকার এক ঐতিহাসিক সংযোগ, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ফজলুল হক কলকাতায় পড়াশোনা শুরু করেন। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে গণিত ও ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্ব অর্জন করেন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। সমকালীন ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন, তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রায় প্রতিবারই কৃতিত্বের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
আইন পড়াশোনা শেষ করে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। আইনপেশায় তাঁর সততা, যুক্তি উপস্থাপনের দক্ষতা এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার মানসিকতা দ্রুত তাঁকে আলাদা করে তোলে। কেবল ধনী-প্রভাবশালীদের হয়ে নয়, তিনি বহু দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পক্ষেও আদালতে লড়াই করেছেন। এতে তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়।
তবে কলকাতায় পেশাগত সাফল্যের মধ্যেও বরিশালের টান তিনি কোনোদিন ভোলেননি। প্রায়ই ছুটিতে তিনি জন্মভূমি বরিশালে ফিরে আসতেন এবং স্থানীয় মানুষের খোঁজখবর নিতেন। কৃষক-শ্রমিকদের দুর্দশা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা তাঁকে ভাবিয়ে তুলত। কলকাতার আধুনিক শিক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা তিনি বরিশালের সামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন।
আইনজীবী জীবনে অর্জিত খ্যাতিই তাঁকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের পথ খুলে দেয়। কলকাতার মঞ্চে তিনি যেমন আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তেমনি বরিশালের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি হয়ে ওঠেন আশার প্রতীক। এই দুই অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন তাঁকে এক অনন্য রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করে—যিনি শহর ও গ্রামের, শিক্ষিত অভিজাত ও দরিদ্র কৃষক—সবার প্রতিনিধি ছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, কলকাতার শিক্ষা ও আইনপেশা ফজলুল হককে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও প্রশাসনিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছিল, আর বরিশালের অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে মানবিক ও কৃষকবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি। এ দুই দিকের মিলন তাঁকে শেরে বাংলা হিসেবে গড়ে তোলে।
আজকের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, শিক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা রাজনীতিকে কীভাবে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ ফজলুল হক। তিনি প্রমাণ করেছেন, উচ্চশিক্ষা ও গ্রামীণ শেকড়ের সমন্বয় একজন নেতাকে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি করে তুলতে পারে।
(চলবে)










