Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য রাজ্যের পতন ও নিঃসঙ্গতার শুরু, যখন হায়দরাবাদ হারায় নিজের মুকুট

রাজ্যের পতন ও নিঃসঙ্গতার শুরু, যখন হায়দরাবাদ হারায় নিজের মুকুট

তারিক-উল-ইসলাম: সোনালি প্রাসাদের ঝলমলে জীবন থেকে যখন ইতিহাস মোড় নেয় বাস্তবতার কঠিন পথে, তখনই শুরু হয় হায়দরাবাদের শেষ নিজাম মুকাররম জাহের জীবনের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। যে রাজবংশ একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রভাবশালী শক্তি ছিল, সেই ঐশ্বর্যের সাম্রাজ্য একে একে ভেঙে পড়তে শুরু করে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউয়ে।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রের সামনে আসে রাজ্য একীকরণের প্রশ্ন। তখনো হায়দরাবাদ ছিল একটি স্বাধীন দেশীয় রাজ্য, যেখানে নিজাম মির ওসমান আলি খান ছিলেন রাজা, আর তাঁর নাতি মুকাররম জাহ তখন তরুণ উত্তরাধিকারী। হায়দরাবাদের নিজামরা চেয়েছিলেন স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে, কিন্তু ইতিহাসের ধারা তাঁদের সেই ইচ্ছাকে মেনে নেয়নি। ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার “অপারেশন পোলো” নামে সামরিক অভিযান চালিয়ে হায়দরাবাদকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করে। সেই অভিযানের পর রাজ্যের স্বাধীনতা শেষ হয়—নিজাম রাজবংশের রাজদণ্ড ইতিহাসের পাতায় স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়।

এই ঘটনার পর থেকে মুকাররম জাহের পরিবার হারায় রাজনৈতিক ক্ষমতা। যদিও ভারত সরকার প্রাথমিকভাবে তাঁদের রাজকীয় মর্যাদা ও প্রিভি পার্স (রাজাদের জন্য নির্ধারিত বার্ষিক ভাতা) বজায় রাখে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা-ও বাতিল হয়ে যায়। রাজকীয় প্রাসাদ ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ তখন পরিণত হয় ভারে। বিশাল রাজপ্রাসাদগুলো পরিণত হয় নীরব স্থাপত্যে, যেখানে রাজাদের গৌরব শুধু স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকে।

মুকাররম জাহ ছিলেন এমন এক রাজপুত্র, যিনি রাজ্য হারানোর পরও ঐতিহ্যের ভার বইতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজের পরিবর্তন, অর্থনৈতিক চাপ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়নি। চারপাশের মানুষ পরিবর্তিত হচ্ছিল, কিন্তু তিনি নিজে রয়ে গিয়েছিলেন অতীতের গৌরবে আবদ্ধ। রাজকীয় সভার চেয়ারে বসে যিনি একসময় শত শত প্রজার সমস্যার সমাধান করতেন, তিনি ধীরে ধীরে এক নিঃসঙ্গ মানুষে পরিণত হন।

এ সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এক দীর্ঘ নিঃসঙ্গ অধ্যায়। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যান নিজেদের জীবনের খোঁজে। তিনি হারান রাজনৈতিক প্রভাব, সামাজিক অবস্থান, এমনকি নিজের সম্পদের উপরও নিয়ন্ত্রণ। রাজবংশের অভ্যন্তরে শুরু হয় সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব।

১৯৬৭ সালে দাদুর মৃত্যুর পর যখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সপ্তম নিজাম হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন রাজ্য ছিল না—শুধু ছিল উত্তরাধিকারের নামমাত্র মর্যাদা। তিনি ছিলেন রাজা, কিন্তু রাজ্যবিহীন। তাঁর রাজদণ্ড ছিল প্রতীকি, আর তাঁর প্রজারা ছিল কেবল স্মৃতির পাতায়।

হায়দরাবাদের রাস্তায় তখনও নিজাম পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল প্রবল, কিন্তু সেই শ্রদ্ধা আর ক্ষমতার প্রতীক ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের প্রতি এক আবেগপূর্ণ স্মৃতি। প্রাসাদের করিডরে বাজত না রাজসঙ্গীত, ঝলমল করত না উৎসবের আলো—বরং ধুলো জমত সোনার আসবাবপত্রে, নীরব হয়ে পড়ত দরবার হল।

এই পতনের সময়েই মুকাররম জাহ বুঝতে পারেন, ঐশ্বর্যের আসল চেহারা কতটা ভঙ্গুর। রাজকীয় জীবন তাঁকে শিখিয়েছিল প্রাচুর্যের মানে, আর পতনের সময় তাঁকে দেখায় একাকিত্বের গভীরতা।

তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতি ও সমাজজীবন থেকে সরে যান। রাজপ্রাসাদের কোলাহল পেরিয়ে এক নির্জন মানুষ হয়ে ওঠেন। তাঁর চোখের সামনে প্রজন্ম বদলে যায়, কিন্তু রাজবংশের গৌরব যেন থেমে থাকে অতীতের প্রাচীরে।

এভাবেই রাজ্যের পতনের সঙ্গে শুরু হয় মুকাররম জাহের নিঃসঙ্গ জীবনের অধ্যায়—এক মানুষ, যিনি রাজা হয়েও রাজ্য হারিয়েছিলেন, ধনকুবের হয়েও হারিয়েছিলেন প্রশান্তি।