কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০টিরও বেশি কনটেইনারবাহী জাহাজ ‘ভাঙার যোগ্য’ তালিকায় থাকলেও, এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও সমুদ্রে পণ্য পরিবহন করে চলেছে। বয়স, জং এবং ক্ষয় থাকা সত্ত্বেও এই জাহাজগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতি, বাজারের ভারসাম্য এবং পরিবর্তিত সময়ের হিসাব-নিকাশের এক নতুন বাস্তবতা তুলে ধরছে। শিপিং শিল্প কোভিড-পরবর্তী অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উত্থান-পতনের সঙ্গে লড়াই করে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আর এর চাপ এসে পড়ছে পুরনো জাহাজগুলোর ওপর।
স্ক্র্যাপিংয়ের মন্থর গতি:
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক সংস্থা BIMCO এবং Clarksons Research জানিয়েছে, পুরনো কনটেইনার জাহাজ ভাঙার হার কিছুটা বাড়লেও এর গতি এখনও খুবই মন্থর। তারা এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, ২০২৫ সালের আগস্ট মাস নাগাদ মন্থর শিপিং বাজারে স্ক্র্যাপিংই একমাত্র ইতিবাচক দিক হবে।
ব্রোকার প্রতিষ্ঠান Braemar-এর তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১৪টি জাহাজ সক্রিয়ভাবে স্ক্র্যাপ প্রস্তাবের খোঁজ করছে, যা সংখ্যায় কম হলেও স্থবিরতা থেকে সামান্য অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়। এর কারণ হলো, অনেক জাহাজ মালিক এখনও পুরনো জাহাজ ছাড়তে রাজি নন, কারণ সামান্য হলেও এই জাহাজগুলো থেকে লাভ আসছে। নতুন জাহাজের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতা বাড়লেও, এই পুরনো জাহাজগুলো তাদের আয়ু কিছুটা বাড়িয়ে এখনও সক্রিয় থাকছে।
নতুন নিয়ম ও ব্যয়ের চাপ:
২০২৫ সালের জুনে কার্যকর হতে যাওয়া ‘হংকং কনভেনশন’ জাহাজ ভাঙা শিল্পে এক বড়সড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এই নতুন নিয়মে বিপজ্জনক পদার্থ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিয়ম চালু করা হয়েছে। যেসব জাহাজে পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেশন নেই, সেগুলোর জন্য এখন স্ক্র্যাপই একমাত্র পথ। কিন্তু এসব নতুন নিয়ম মানতে গিয়ে ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ক্র্যাপ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান GMS ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ১০ হাজারের বেশি শ্রমিককে নতুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে সুরক্ষা বাড়লেও খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক মালিক দ্বিধায় পড়েছেন; কারণ জাহাজটি যদি এখনও সামান্য লাভ দেয়, তবে বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ স্ক্র্যাপের সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
অতিরিক্ত জাহাজ, কম চাহিদা:
বিশ্বব্যাপী কনটেইনার পরিবহনে দীর্ঘদিন ধরেই জাহাজের সক্ষমতা বাড়তির দিকে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২.৪৭ লাখ টিইইউ ক্ষমতার জাহাজ ভাঙা হয়, অথচ ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক জাহাজ বহরের ক্ষমতা ৩১.৪ মিলিয়ন টিইইউ ছাড়িয়ে যাবে। এর বিপরীতে, বাণিজ্যিক চাহিদা বাড়ছে মাত্র ৪ শতাংশ হারে, যা এই ভারসাম্যে বড় ধরনের ফারাক তৈরি করছে।
এই ভারসাম্যহীনতা মোকাবিলায় শিপিং কোম্পানিগুলো নানা কৌশল নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কিছু যাত্রা বাতিল করা, ইচ্ছাকৃতভাবে জাহাজের গতি কমানো (slow steaming) কিংবা সুয়েজ খাল এড়িয়ে কেপ অফ গুড হোপ হয়ে দীর্ঘ পথ ব্যবহার করা। এই কৌশলগুলো অতিরিক্ত জাহাজগুলোকে আরও কিছুটা সময় ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
মানবিক বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন:
প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নাবিক, মালিক এবং স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডের হাজারো শ্রমিকের জীবিকা। পুরনো জাহাজ ভাঙা মানে কেবল অর্থনৈতিক সম্পদের ক্ষতি নয়, বহু মানুষের কাজ হারানোর আশঙ্কাও তৈরি হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ইয়ার্ডগুলোতে এখন নতুন পরিবেশ ও সুরক্ষা মান মেনে কাজ চললেও, এর ফলে খরচ আরও বেড়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে অনেক জাহাজ মালিক এখনও অপেক্ষা করছেন, যতদিন না বাজার পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আসে অথবা স্ক্র্যাপ খরচ নিয়ন্ত্রণে আসে।
সমুদ্রপথে চলতে থাকা এই পুরনো জাহাজগুলো আজ বৈশ্বিক বাণিজ্যের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। অর্থনীতি, নতুন পরিবেশগত নিয়মনীতি এবং মানবিক বাস্তবতার এক জটিল ভারসাম্যই এখন ঠিক করছে—কোন জাহাজগুলো ঢেউয়ে ভেসে চলবে, আর কোনটি যাবে ভাঙার ঘাটে তার শেষ যাত্রায়।










