বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: এক সময় দুই দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক বন্ধন ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতীক ছিল মৈত্রী, মিতালি ও বন্ধন এক্সপ্রেস। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অস্থিরতার পর থেকে গত ১৫ মাস ধরে এই তিন আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেনের চাকা থেমে আছে। এখন বাংলাদেশ আবারও ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিতে যাচ্ছে ট্রেনগুলো চালুর প্রস্তাব জানিয়ে।
বিষয়টি আর শুধু রেল যোগাযোগের নয়, এটি এখন পরিণত হয়েছে এক ধরনের কূটনৈতিক পরীক্ষায়। কারণ, রেলপথ মন্ত্রণালয় যতই প্রস্তুত থাকুক, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে দিল্লি থেকে। আর ভারত এখনো নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ট্রেন চলাচলে সম্মতি দেয়নি।
আগামী মার্চে অনুষ্ঠিতব্য ‘ইন্ট্রা-গভর্নমেন্ট রেলওয়ে মিটিং’ (আইজিআরএম)-এর প্রস্তুতি সভায় এ বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২৩ অক্টোবর এই সিদ্ধান্তের কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর করেছেন রেলপথ সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ এবার শুধু ট্রেন চালুর অনুরোধই নয়, বরং বেশ কিছু নতুন প্রস্তাবও দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—যাত্রীদের লাগেজ পরিবহনের জন্য পৃথক লাগেজ ভ্যান সংযুক্ত করা এবং মৈত্রী এক্সপ্রেসকে নতুন রুটে, অর্থাৎ পদ্মা সেতু হয়ে চালানোর পরিকল্পনা। পদ্মা সেতু ব্যবহার করে এই ট্রেন চললে ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাত্রা সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা কমে আসবে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের ভাষায়, “আমরা চিঠি দিয়েছি, আবারও দেব। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো জবাব আসেনি। নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখিয়ে তারা এখনও রাজি নয়।”
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেনের মতে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। “আমাদের ট্রেন, লোকবল, অবকাঠামো সবই প্রস্তুত। ভারত চাইলেই আগামীকাল থেকেই ট্রেন চালানো সম্ভব।”
রেলওয়ের ভেতর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, মিতালি এক্সপ্রেসের খালি রেক অনেক দিন ধরে ঢাকায় আটকে থাকার পর বিশেষ নিরাপত্তায় সীমান্তে ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়া মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপ্রেসেরও রুট প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেন ভারতীয় সম্মতি মিললেই চলাচল শুরু করা যায়।
তবে দিল্লির প্রতিক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত। ভারতীয় পক্ষের নিরাপত্তা উদ্বেগ কেবল রেল চলাচল নয়, কনস্যুলার কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলেছে। ঢাকায় ‘বন্ধ’ থাকা ট্রেনভিত্তিক ভিসা সেবা চালু করতেও ভারত এখনো আগ্রহ দেখায়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, “এটি সম্পূর্ণ কূটনৈতিক বিষয়। সমঝোতা না হলে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। ভারত আগের চিঠিগুলোর জবাবও দেয়নি।”
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এখন আটটি ইন্টারচেঞ্জের মধ্যে পাঁচটি সচল। এর তিনটিতেই আগে নিয়মিত যাত্রীবাহী ট্রেন চলত। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশজুড়ে আন্দোলনের সময় ট্রেন বন্ধ হওয়ার পর থেকে যাত্রীবাহী সংযোগ আর চালু হয়নি, যদিও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই স্থবিরতা কেবল পরিবহন নয়, দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা ও আঞ্চলিক সংযোগকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক একীকরণের পথে এটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের নতুন এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অবশেষে সেই বন্ধ দরজা খুলে দিতে পারে কি না।










