কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন উত্তেজনা তুঙ্গে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, রাজ্যের রাজনৈতিক আবহ ততই গরম হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলো মাঠে নেমেছে ভোটার তালিকা সংশোধন থেকে শুরু করে জনসংযোগ পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে অবস্থান শক্ত করতে। বর্তমান সময়ের মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে ভোটার তালিকার বিশেষ পুনর্বিবেচনা বা ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR)’ কার্যক্রম, যা নিয়ে রাজ্যজুড়ে চলছে বিতর্ক, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ।
ভোটার তালিকা রিভিশন নিয়ে বিতর্ক
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার নিবিড় যাচাই অভিযান। এই ‘SIR’ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি এলাকায় ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নেমে এসেছে তীব্র উত্তেজনা। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করেছে, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বিরোধীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষকে তালিকা থেকে বাদ দিতে চাইছে। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ৪ নভেম্বর কলকাতায় বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।
অন্যদিকে বিজেপি দাবি করছে, তৃণমূল সরকার নির্বাচন প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক যন্ত্র ব্যবহার করে বুথে অনিয়ম চালাতে চায়। দলটি ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০ হাজার বুথ-স্তরের কর্মীকে সক্রিয় করছে ভোটার যাচাই অভিযানে অংশ নিতে। বিজেপির লক্ষ্য, প্রতিটি এলাকায় নিজেদের সাংগঠনিক উপস্থিতি জোরদার করা এবং আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া।
মাটুয়া ও সীমান্ত রাজনীতি
রাজ্যে মাটুয়া সম্প্রদায়ের ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ইস্যু এবং ভোটার তালিকা রিভিশনের কারণে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লে নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিজেপি ও তৃণমূল উভয় দলই এখন মাটুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রচারণা জোরদার করছে। সীমান্তবর্তী জেলা উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া এলাকায় ভোটার যাচাই কার্যক্রম ঘিরে স্থানীয় প্রশাসনও কঠোর সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তা প্রশ্ন
রাজ্যের বহু বুথলেভেল অফিসার (BLO) নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভোটার যাচাইয়ের সময় রাজনৈতিক দলের চাপ, হুমকি এবং প্রশাসনিক জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় তারা অনেক এলাকায় বিক্ষোভও করেছেন। কলকাতা, হুগলি, নদিয়া ও মালদহে কয়েক জায়গায় প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
রাজনীতিবিদরা বলছেন, ভোটার তালিকা ও ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করে এভাবে উত্তেজনা বাড়া রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য ভালো সংকেত নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে এই বিতর্ক উভয় বড় দলকেই সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে— তৃণমূল রাস্তায় আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত গঠনে মনোযোগ দিচ্ছে, আর বিজেপি নিচুতলার সংগঠনকে শক্ত করছে।
ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভোটব্যাংক রাজনীতি
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্ম ও সংস্কৃতির বিষয়ও ক্রমেই প্রভাব ফেলছে। বিজেপি এখন হিন্দুত্ব-ভিত্তিক রাজনৈতিক বার্তা জোরালো করছে, অন্যদিকে তৃণমূল “মা-মাটি-মানুষ” স্লোগানে সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক তুলে ধরছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাম্প্রতিক বক্তব্যে বলেছেন, “বঙ্গের মাটি কোনো বিভাজনের রাজনীতি মেনে নেবে না।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজ্যে বিজেপি-তৃণমূল দ্বৈরথ এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিসরেও প্রভাব বিস্তার করছে। গ্রামীণ ভোটব্যাংকে ধর্মীয় প্রভাব বাড়লেও শহুরে ভোটারদের কাছে কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি ও নাগরিক সেবা এখনো বড় ইস্যু হয়ে রয়েছে।
আগামীর চিত্র
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় পরীক্ষার মঞ্চ হতে চলেছে। একদিকে তৃণমূল তাদের টানা তৃতীয় মেয়াদ রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করছে, অন্যদিকে বিজেপি রাজ্যে সরকার গঠনের আশায় সংগঠন পুনর্গঠনে ব্যস্ত। ভোটার তালিকা রিভিশন ইস্যুটি এই নির্বাচনের আগেই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, যা থেকে রাজ্যজুড়ে এক ধরনের অবিশ্বাস ও উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।
রাজনীতির এই উত্তপ্ত আবহে সাধারণ মানুষ চাইছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে বাস্তব উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা হোক। তবে আপাতত রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, আগামী মাসগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আরও উত্তপ্ত ও মুখোমুখি সংঘর্ষমুখী হতে চলেছে।









