বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, আগরতলা: ত্রিপুরার রাজনীতিতে মানিক সরকার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত। ভারতের ইতিহাসে এমন রাজনৈতিক নেতা খুব কমই আছেন, যিনি দীর্ঘ সময় শাসন করেছেন এবং একই সঙ্গে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, আর এই দীর্ঘ শাসনকালে তিনি সাদামাটা জীবন, নৈতিকতার প্রতি অটলতা এবং জনগণের কল্যাণে অঙ্গীকারের জন্য সমাদৃত হয়েছেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও রাজনৈতিক যাত্রা
মানিক সরকার জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪৯ সালের ২২ জানুয়ারি, ত্রিপুরার রাধকিশোরপুরে। পিতা ছিলেন একজন দর্জি এবং মাতা সরকারি কর্মচারী। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি মহারাজা বীরবিক্রম কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, ১৯৬৮ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে সিপিআই ( এম )-এ যোগ দেন।
শুরুটা ছিল সাধারণ ছাত্র-রাজনীতির মধ্য দিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি পার্টির রাজ্য পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৮০ সালে প্রথমবার রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচিত হওয়া মানিক সরকার পরবর্তী দুই দশক ধরে ত্রিপুরার রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে সক্রিয় থাকেন।
সাদামাটা জীবন ও জনকল্যাণমুখী শাসন
মানিক সরকারের পরিচয় অন্যদের থেকে আলাদা করেছেন তার সাদামাটা জীবনযাপন ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব। শাসনকালে নিজের বেতন পুরোপুরি পার্টিতে দান করতেন এবং কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বড় বাড়ি বা বিলাসবহুল গাড়ি রাখতেন না। তাই তাকে “ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র মুখ্যমন্ত্রী” হিসেবে অভিহিত করা হয়।
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এই ধরনের নৈতিকতা এবং স্বচ্ছতা বিরল। জনগণের অর্থ এবং সরকারি সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতিতে সততা এবং জনসেবার মধ্যে সরাসরি সংযোগ থাকতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব ও রাজ্য উন্নয়ন
মানিক সরকারের শাসনকালে ত্রিপুরায় স্থিতিশীল রাজনীতি বজায় থাকে। কৃষি, শিক্ষা, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় কৃষকদের জন্য নতুন উদ্যোগ চালু করা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে দীর্ঘ শাসনের কারণে কিছু সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জও দেখা যায়। বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন যে প্রশাসনিক কিছু ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি এবং উদ্ভাবনের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পার্টি ক্ষমতা হারায়।
রাজনৈতিক আদর্শ ও শিক্ষণীয় দিক
মানিক সরকার প্রমাণ করেছেন যে রাজনীতি হওয়া যায় নির্ভরযোগ্য, নৈতিক এবং জনকল্যাণমুখী। তার শাসনের মূল নীতি ছিল:
- জনগণের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া
- ব্যক্তিগত স্বার্থকে রাজনীতির উপরে না ওঠানো
- সততা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা
এই দিকগুলো তাকে ত্রিপুরার ইতিহাসে একটি অদ্বিতীয় রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে স্থাপন করেছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেক দেশে নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্ষমতার লোভে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এ প্রেক্ষাপটে মানিক সরকার আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, রাজনীতি জনগণের জন্য করা উচিত, ক্ষমতার জন্য নয়। তার জীবন এবং নেতৃত্বের ধারা নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের জন্য এক শিক্ষা: সততা, নৈতিকতা এবং জনসেবা কোনো অবস্থাতেই ত্যাগ করা যাবে না।
ত্রিপুরার এই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শুধু বামপন্থী রাজনীতির প্রতীক নন, বরং তিনি একজন আদর্শ রাজনৈতিক চরিত্র, যাকে অনুসরণ করলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব।










