Home আন্তর্জাতিক দক্ষিণ এশীয় প্রবাসী রাজনীতির নতুন নায়ক: জোহরান মামদানি

দক্ষিণ এশীয় প্রবাসী রাজনীতির নতুন নায়ক: জোহরান মামদানি

জোহরান মামদানি
মোস্তফা তারেক, নিউইয়র্ক: নিউইয়র্কের ক্ষমতার শীর্ষে উঠে ইতিহাস গড়েছেন জোহরান মামদানি। ৩৪ বছর বয়সি ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম, যিনি একদিকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতীক, অন্যদিকে অভিবাসী প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের পুনর্জন্মের মুখপাত্র। তিনি শুধু নিউইয়র্কের নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশীয় প্রবাসী রাজনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছেন।

মামদানির জয় দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী রাজনীতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানি সম্প্রদায় রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও তারা প্রায়শই নিজেদের ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় আড়াল করে চলেছেন। একসময় পিয়ুষ ‘ববি’ জিন্দাল নিজের নাম ও ধর্ম বদলে রাজনীতিতে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, আর আজ মামদানি প্রকাশ্যে বলছেন, “আমি গর্বিত মুসলিম এবং আমি গর্বিত ভারতীয়।” এই আত্মবিশ্বাসই অভিবাসী রাজনীতির প্রজন্মান্তর পরিবর্তনের প্রতীক।

মামদানির উত্থান প্রমাণ করে, নতুন প্রজন্মের দক্ষিণ এশীয় আমেরিকানরা আর রাজনীতিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রতীক হিসেবে দেখছে না। তারা এখন চায় সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা, এবং রাষ্ট্রের মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে অংশ নিতে। সেই কারণেই মামদানির নির্বাচনী ইশতেহারে ভাড়ার স্থিতি, বিনামূল্যে গণপরিবহন, ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধি, ও সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের মতো নীতিগুলি প্রবাসী তরুণ ভোটারদের কাছে গভীর সাড়া ফেলেছে।

এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেক তরুণ ভোটারই প্রথমবারের মতো ব্যালট বাক্সে গিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, মামদানির মধ্যে তাঁরা এমন এক মুখ দেখেছেন, যে তাদের মতোই অভিবাসী পরিবারের সন্তান, বৈষম্যের অভিজ্ঞতায় বড় হয়েছে, তবু নিজের পরিচয় লুকোয়নি। ফলে তাঁর জয় কেবল রাজনৈতিক সাফল্য নয়, বরং দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী সমাজের আত্মমর্যাদার পুনর্দখল।

তবে এই উত্থান সহজ ছিল না। নিউইয়র্কের মতো এক বিশ্বনগরে সমাজতন্ত্র, ইসলাম ও দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণে প্রচার চালানো মানে ছিল মূলধারার রাজনীতির বিরোধিতা করা। যুক্তরাষ্ট্রে যখন ইজরায়েলপন্থী লবির প্রভাব গভীর, তখন মামদানি প্রকাশ্যে গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে বলেন, “ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়ানো অপরাধ নয়।” এই অবস্থান তাঁকে পশ্চিমা গণমাধ্যমের নজরে এনে দেয়, আবার অনেক প্রবাসী ভারতীয় সংগঠনের বিরুদ্ধেও দাঁড় করায়।

তবু তাঁর এই অবস্থানই তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার প্রতীক করে তুলেছে। লন্ডনের সাদিক খানের পর মামদানিই এখন সেই বিরল মুখ, যিনি মুসলিম, দক্ষিণ এশীয় ও অভিবাসী, এই তিন পরিচয়কেই একসঙ্গে বহন করছেন গর্বের সঙ্গে। তাঁদের সাফল্য প্রমাণ করছে, ধর্ম বা জাতিগত পরিচয় নয়, নেতৃত্বের পরিমাপ এখন মানবিকতা ও ন্যায়বোধে।

মামদানির জয়ের পর এখন বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশীয় প্রবাসী রাজনীতি একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। অভিবাসীদের মধ্যে যে তরুণ প্রজন্ম নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, লন্ডন বা টরন্টোর মতো শহরে বড় হচ্ছে, তারা আর “মডেল মাইনরিটি” তকমায় বিশ্বাস করে না। তারা চায় সমান মর্যাদা, অংশগ্রহণ এবং সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা। মামদানির জয় সেই পরিবর্তনের প্রতীকী সূচনা।

এ কারণেই তাঁর বিজয় কেবল নিউইয়র্কের নয়, এটি মুম্বাই, লাহোর, ঢাকা, কলম্বো এবং কাঠমান্ডু থেকে উঠে আসা কোটি অভিবাসীর স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, নিজের ঐতিহ্য লুকিয়ে নয়, বরং গর্বের সঙ্গে ধারণ করেই বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব।