ইয়াঙ্গুন সফর: এক সাংবাদিকের চোখে (পর্ব–৪)
কামরুল ইসলাম: ২০০৩ সালের মার্চ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্ক তখন এক নতুন মোড়ের দিকে এগোচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যাচ্ছেন ইয়াঙ্গুনে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বন্দর সংযোগ এবং সীমান্ত সহযোগিতা জোরদার করার প্রত্যাশায়। আমি তখন চট্টগ্রামভিত্তিক একটি দৈনিকের বিশেষ প্রতিনিধি। বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সৌজন্যে সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।

বিমানে ওঠার মুহূর্ত থেকেই বুঝতে পারছিলাম, সফরটি বিশেষ। এক পাশে প্রধানমন্ত্রী, অন্য পাশে তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা দল। মাঝখানে আমরা, সংবাদকর্মীরা। যাত্রার মাঝপথে তরুণ তারেক রহমান উঠে দাঁড়িয়ে সকলের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করলেন। তার আচরণ ছিল বিনয়ী ও সংযত—কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, কেবল সৌজন্যের উষ্ণতা।
ইয়াঙ্গুন পৌঁছালে বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং একদল সামরিক কর্মকর্তা। দেশটি তখন জেনারেল থান শুয়ের শাসনাধীন। শহরজুড়ে সেনা উপস্থিতি চোখে পড়ছিল, তবে সবকিছুই ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের মূল লক্ষ্য ছিল দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। বিশেষভাবে চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুন বন্দরের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল স্থাপন, সীমান্ত বাণিজ্য সহজ করা এবং রাস্তাঘাটে সহযোগিতা বৃদ্ধি। তখন আমি ভাবছিলাম, একসময় এই দুটি বন্দর ব্রিটিশ আমলের সোনালি বাণিজ্য রুটের অংশ ছিল, এখন রাজনৈতিক দূরত্বে কতটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
২০ মার্চ স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুনের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হবে। এর আগে এই দুই দেশের কার্গো সিঙ্গাপুর হয়ে যেত। পাশাপাশি যৌথ বাণিজ্য কমিশন ও দ্বিপাক্ষিক ট্রেডিং অ্যাকাউন্টও গঠন করা হয়, যা বাণিজ্যকে আরও সহজ করবে।
সফরের দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ-মিয়ানমার বাণিজ্য বৈঠক। উপস্থিত ছিলেন দুই দেশের মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল। সাংবাদিকদের কক্ষে বসে আমি লক্ষ্য করছিলাম, আলোচনায় বারবার চট্টগ্রাম বন্দরের নাম উচ্চারিত হচ্ছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন,
“ইয়াঙ্গুন ও চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে যোগাযোগ জোরদার হলে এটি শুধু দুই দেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।”
সেদিন সন্ধ্যায় হোটেল ট্রেডার্সে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে আমরা কাজ করছিলাম। পাশের হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হলেও, সেই আন্তরিকতা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। সরকারি সফর আর ব্যক্তিগত সংযোগ একসাথে মিলেমিশে মানবিক আবহ তৈরি করেছিল।
সফরের তৃতীয় দিন তুলনামূলকভাবে হালকা ছিল। বিকেলে আয়োজিত হয় আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ। সোনালি আলোয় সজ্জিত প্রাসাদসদৃশ হলঘরে দাঁড়িয়ে আমি নোট নিচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, শুধু প্রতিবেদনের জন্য নয়, এখানে ইতিহাসের একটি অধ্যায় লেখা হচ্ছে।
চার দিনের সফর শেষে বিমানে উঠার সময় অনুভব করলাম, আমি শুধু একটি রাজনৈতিক সফর কভার করিনি। প্রত্যক্ষ করেছি সেই অধ্যায় যেখানে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের নতুন দ্বার খোলার প্রস্তুতি চলছিল। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বন্দর, নদী আর অসংখ্য আলো। মনে হচ্ছিল, এই সফর কেবল সীমান্ত কূটনীতি নয়, বরং স্মৃতির নদীতে এক নতুন যাত্রার সূচনা।










