কামরুল ইসলাম: আমার মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে— “আমার কাছে যদি একটি কামান থাকত, তাহলে ইংরেজি দৈনিকটির কার্যালয় উড়িয়ে দিতাম”? এই কথাটা হয়তো এবার বলবেন তিনি। ভাবছেন কে বলছেন, বা কেন বলছেন? এর উত্তর পেতে হলে ফিরতে হবে প্রায় এক দশক আগের এক ঘটনার স্মৃতিতে, যা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। তবে সম্প্রতি একটি ঘটনা সবটা নতুন করে মনে করিয়ে দিল।
তখন আমি চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি দৈনিক সংবাদপত্রে কাজ করি। আমার মূল কাজ ছিল বিজনেস এবং শিপিং খাতের খবর সংগ্রহ ও পরিবেশন করা। চট্টগ্রাম বন্দর তখন আমার রিপোর্টিংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল।
একদিন জানতে পারলাম, চট্টগ্রাম বন্দরে বিধি বহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের জন্য একটি নতুন “ফাঁদ” পাতার সব আয়োজন চূড়ান্ত। এই ধরনের অনিয়ম দেশের অর্থনীতি এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা আমার কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। আমি সবিস্তারে পুরো বিষয়টি নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করি এবং তা প্রকাশিত হয়। আমার সেই রিপোর্টের সুবাদে সেই অন্যায় পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায়।
কিন্তু আমার সেই প্রতিবেদন বন্দরের একটি নির্দিষ্ট শাখার প্রধানকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন। মনে হচ্ছিল, আমার ওপর তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ জন্মেছে। এই ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় দৈনিক ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান মো. সালাহউদ্দিন সেই বন্দর কর্মকর্তার অফিসে যান। সেখানেই সেই কর্মকর্তা তার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন সরাসরি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় সালাহউদ্দিন সাহেবকে বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছে যদি একটি বন্দুক থাকতো তাহলে কামরুল ইসলামকে গুলি করে দিতাম।’’
কথাটি শুনে আমি তখন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি জনসেবার দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি কীভাবে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন হিংসাত্মক কথা বলতে পারেন? তবুও, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন হুমকি বা প্রতিকূলতা নতুন কিছু ছিল না। সময় গড়িয়েছে, সেই কর্মকর্তা অবশ্য এখন আর চট্টগ্রাম বন্দরে নেই। তাঁর কর্মস্থল পরিবর্তন হয়েছে।
সেই ঘটনাটি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। হঠাৎ করে মনে পড়লো গত কয়েক দিন আগে। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিকে সেই একই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একগাদা দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেই খবরগুলো পড়তে গিয়েই আমার মনে পড়লো দশ বছর আগের সেই বন্দুকের হুমকির ঘটনা।
তখন তিনি আমাকে গুলি করার কথা বলেছিলেন, কারণ আমি তাঁর একটি অবৈধ আয়োজন প্রকাশ করে দিয়েছিলাম। এখন যখন তাঁর বিরুদ্ধে আরও বড় পরিসরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং একটি জাতীয় দৈনিক তা প্রকাশ করেছে, তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি এবার তিনি বলবেন “আমার কাছে যদি একটি কামান থাকত, তাহলে সেই ইংরেজি দৈনিকটির কার্যালয় উড়িয়ে দিতাম”?
ভাবতে অবাক লাগে, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়ম প্রকাশ পেলে কিছু মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কীভাবে এমন চরম রূপ নেয়। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কেবল সত্য প্রকাশ করা, তা যত অপ্রিয়ই হোক না কেন। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আমরা মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, যা জীবনের ডায়েরিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে। এই ঘটনাও তেমনই একটি।










