Home অন্যান্য ভালোবাসার ছদ্মবেশে গুপ্তচর: যুদ্ধ ও রাজনীতির নীরব খেলা

ভালোবাসার ছদ্মবেশে গুপ্তচর: যুদ্ধ ও রাজনীতির নীরব খেলা

ছবি: এ আই

ফিচার প্রতিবেদন

তারিক-উল-ইসলাম: গোয়েন্দা জগতের ইতিহাসে এমন এক রহস্যময় অধ্যায় আছে, যেখানে প্রেম, প্রলোভন ও বিশ্বাসঘাতকতা মিলেমিশে তৈরি করেছে রাজনৈতিক নাটক। সেটি হলো “সেক্স স্পাই” বা যৌন গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস। এই কৌশল শুধু গুপ্তচরদের হাতে নয়, রাজনীতি ও যুদ্ধের গতিপথও বহুবার বদলে দিয়েছে।

প্রাচীন রাজসভা থেকে শুরু

যৌনতা ও প্রলোভনকে তথ্য আহরণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়েছিল বহু আগে। প্রাচীন রোম ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে রাজদরবারে নারীদের মাধ্যমে গোপন বার্তা পাঠানো বা শত্রুর পরিকল্পনা জানার নজির পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, অনেক সময় রাজাদের প্রিয় নারীরাই শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করতেন। এভাবেই জন্ম নেয় “হানিট্র্যাপ” বা প্রেমের ফাঁদ কৌশল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: মাতা হারির কিংবদন্তি

সেক্স স্পাইয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম মাতা হারি। ডাচ নৃত্যশিল্পী মার্গারেথা জেলে তার নৃত্যের মায়ায় মুগ্ধ করেছিলেন ইউরোপের রাজকর্মচারী থেকে সেনা কর্মকর্তাদের। ফ্রান্সের দৃষ্টিতে তিনি জার্মানির জন্য গুপ্তচর ছিলেন, আবার অনেকে মনে করেন, তিনি কেবল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। ১৯১৭ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা মাতা হারি আজও রয়ে গেছেন সেক্স স্পাইয়ের প্রতীক হিসেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: নারী গুপ্তচরের উত্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নারী গুপ্তচরদের ব্যবহারে আরো দক্ষ হয়ে ওঠে। জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন, সব পক্ষই প্রশিক্ষিত নারীদের শত্রুপক্ষের সেনা বা কূটনীতিকদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের কাজে লাগায়। অনেক সময় এসব নারীরা যুদ্ধবন্দী বা অভিজাত সমাজের সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন।

ঠান্ডা যুদ্ধ: গুপ্তচরবৃত্তির সোনালি যুগ

১৯৫০ থেকে ১৯৮০-এর দশক,সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার “ঠান্ডা যুদ্ধ” যুগেই সেক্স স্পাই কার্যক্রম সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই সময় রাশিয়ার “কেজিবি” ও পশ্চিমা বিশ্বের “সিআইএ” উভয়ই যৌন সম্পর্ককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে আলোড়ন তোলা ক্রিস্টিন কিলার ঘটনা (১৯৬৩) এর বড় উদাহরণ। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ফাঁস হলে গোটা সরকার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। একইভাবে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বহু পশ্চিমা কূটনীতিককে “হানিট্র্যাপ” ব্যবহার করে ফাঁদে ফেলেছিল।

আধুনিক যুগ: ডিজিটাল হানিট্র্যাপ

২১ শতকে এসে সেক্স স্পাই কৌশল শুধু শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় সীমিত নেই। এখন এটি সাইবার জগতেও প্রবেশ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন ডেটিং অ্যাপগুলোতে “ফেক প্রোফাইল” তৈরি করে লক্ষ্যবস্তু ব্যক্তিকে প্রলোভনে ফেলার কৌশল চালু হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য সংগ্রহ ও ব্ল্যাকমেইলের জন্য “ডিজিটাল সেক্স স্পাই” নিয়োগ করছে।

নৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা

যৌন প্রলোভনকে গুপ্তচরবৃত্তির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা সবসময়ই বিতর্কিত। এতে একদিকে মানবিক মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু ইতিহাস বলছে, যুদ্ধ কিংবা কূটনীতি, যেখানেই গোপন তথ্যের মূল্য থাকে, সেখানেই “প্রেম” ও “প্রলোভন” প্রভাব বিস্তার করেছে নীরবে।

উপসংহার

সেক্স স্পাইয়ের গল্পগুলো কখনো কেলেঙ্কারির, কখনো বীরত্বের, আবার কখনো করুণ মৃত্যুর। মাতা হারি থেকে আনা চ্যাপম্যান, সবাই মিলে প্রমাণ করেছেন, গোয়েন্দা যুদ্ধের ময়দানে ভালোবাসাও হতে পারে অস্ত্র। এই অস্ত্র অদৃশ্য, কিন্তু এর আঘাত রাজনৈতিক ইতিহাসে অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে।