লকেটের ছায়া
স্মৃতি হাসান
বৃষ্টিভেজা বিকেলটির পর থেকে অনুপমের মন যেন অদ্ভুত এক উত্তেজনার মধ্যে আটকে আছে।
মেয়েটির চোখ, তার অচেনা অথচ পরিচিত হাসি, আর বইয়ের পাতায় রেখে যাওয়া সেই রহস্যময় বার্তা—সবই তার ভেতর অস্থিরতা তৈরি করছে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছিল সেই তারিখ আর জায়গা।
ফয়েজ লেকের শেষপ্রান্তে, যেখানে বছর ছয়েক আগে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়েছিল—সেই জায়গায় মেয়েটি তাকে ডাকছে।
সেই দিন, একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে উঠে এসেছিল। অনুপম শেষ মুহূর্তে কারো হাত ধরে রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু বিশৃঙ্খলার মধ্যে সে বুঝতেই পারেনি, কে তাকে বাঁচিয়েছিল।
এখন সেই মেয়েটি সেই একই জায়গার নাম লিখে রেখেছে।
কেন?
পরবর্তী তিন দিন অনুপম ঘুমাতে পারছিল না। স্বপ্নে বারবার ফিরে আসছে সেই দৃশ্য—অন্ধকার রাস্তা, ট্রাকের হেডলাইট, আর একটি হাত তাকে টেনে ধরছে। কখনো মনে হচ্ছে মেয়েটিই, কখনো অন্য কেউ।
একদিন রাতে, হঠাৎ তার পুরনো বন্ধু, আরিফ, বাসায় আসে। তারা ছয় বছর ধরে দেখা হয়নি।
“অনুপম, তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু গোপন রহস্য আছে। কিছু ঘটেছে?” আরিফ প্রশ্ন করল।
অনুপম দ্বিধা করেও সব বলল—বইয়ের দোকান, মেয়েটি, লকেট, রহস্যময় বার্তা।
আরিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“দুর্ঘটনার রাতে তুই আমাকে ফোন করেছিলি। তুই বলেছিলি কিছু গুরুত্বপূর্ণ হারিয়ে গেছে—কিছু যা মেয়েটির জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পরের দিনই তুই ভুলে গেছিস।”
অনুপমের বুক কেঁপে উঠল।
“আমি কি হারিয়েছি?”
আরিফ মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
হঠাৎ অনুপমের মনে ভেসে উঠল এক স্মৃতি…
কিশোর বয়সে পতেঙ্গা সৈকতের সেই বিকেল। হালকা নীল পোশাক পরা লাজুক এক মেয়ে সমুদ্রের ধারে হাঁটছিল। বিদায়ের সময়, অনুপম বলেছিল,
“যদি কখনো হারিয়ে যাও, আমি একটি জিনিস দেব, যা আমাদের স্মৃতিকে ধরে রাখবে।”
কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে সে লকেটটি দিতে পারেনি।
তবে, সেই লকেট কি মেয়েটির কাছে পৌঁছেছে?
এটাই কি মেয়েটির কাছে থাকা রহস্যময় বার্তার মূল বিষয়?
পরদিন অনুপম বইয়ের দোকানে গেল, যেখানে প্রথমবার মেয়েটিকে দেখেছিল।
দোকানদার বৃদ্ধ ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন,
“অদ্ভুত মেয়ে। সে আজ এসেছিল। বলেছিল, আপনি আসবেন। কিন্তু সে খুব অস্থির ছিল।”
বৃদ্ধ আরও বললেন,
“সেই দিনে কেউ তাকে খুঁজছিল। একজন অচেনা পুরুষ। সে বলেছিল, মেয়েটি যদি এখানে আসে, আমাকে খবর দিবেন। ওটা শুধু একটি জিনিসের জন্য—একটি ধাতব জিনিস, যা হারালে মেয়েটির জীবন বদলে যাবে।”
অনুপম কাঁপা গলায় বলল,
“লকেট?”
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বললেন,
“হয়তো। মেয়েটি খুব দ্রুত দোকান ছাড়ল। আমি তাকে আটকাতে পারিনি।”
দোকানের টেবিলের নিচে একটি ছোট প্যাকেট ছিল। বৃদ্ধ বলেন,
“সে আমাকে এটি দিতে বলেছিল। বলেছিল, আপনি সত্যের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত যেন না খুলি।”
অনুপম হাতে নিল। প্যাকেটের ভেতরে একটি খাম এবং একটি ছোট কাগজ। খামের ওপর লেখা—
“Remember before you forget again.”
‘ভুলে যাওয়ার আগে মনে করো।’
খোলা কাগজে লেখা ছিল—
“তোমার স্মৃতি পুরোটা হারায়নি। শুধু চাপা পড়ে আছে।
সেই দিন বাতিঘরের নিচে তুমি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে—তা ভাঙলে, তোমার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।
আর যে মানুষটা আমাকে খুঁজছে… সে লকেটের জন্যই খুঁজছে।
কারণ লকেটের ভেতরে সেই তথ্য আছে, যা কারো জীবনও বাঁচাতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে।”
অতএব, লকেট কেবল স্মৃতির জিনিস নয়। এর ভেতরে লুকানো তথ্য আছে, যা অনুপম এবং মেয়েটির জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
খামের নিচে আরেকটি ছোট কাগজে লেখা—
“তুমি আমাকে চিনবে… কিন্তু মনে করতে পারবে শুধুমাত্র যখন তার আগেই কেউ তোমাকে থামাতে না পারে।”
অন্যদিকে, আরিফ তার কাঁধে হাত রাখল।
“অনুপম, মনে রাখিস, তুমি একা নও। এটা শুধু প্রেমের গল্প নয়, এটি জীবন ও স্মৃতির এক রহস্যময় যাত্রা।”
তিন দিনের মধ্যে পূর্ণিমার রাত ফয়েজ লেকে। সেই রাত অনুপমকে নতুন বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।
মেয়েটি, লকেট, অতীতের স্মৃতি—সবই এখন এক অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে গেঁথে গেছে।
পরবর্তী পর্বের জন্য আগামীকাল ভিজিট করুন: businesstoday24.com










