Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য মাতা হারি ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রহস্য

মাতা হারি ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রহস্য

প্রেম, প্রলোভন ও গুপ্তচরবৃত্তি: সেক্স স্পাইয়ের গোপন ইতিহাস

পর্ব ২:

তারিক-উল-ইসলাম

ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যেগুলো শুনলেই রহস্য আর আকর্ষণের আবহ তৈরি হয়। “মাতা হারি” এমনই এক নাম, যিনি ছিলেন নর্তকী, প্রেমিকা, অভিযুক্ত গুপ্তচর এবং অবশেষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এক নারীর গল্প গোয়েন্দা ইতিহাসে প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

ডাচ কন্যা থেকে নৃত্যের দেবী

১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডসের ছোট শহর লিউয়ারডেনে জন্ম নেন মার্গারেথা গিরট্রুইদা জেলে, যিনি পরে মঞ্চনামে পরিচিত হন “মাতা হারি” হিসেবে, ইন্দোনেশীয় ভাষায় যার অর্থ “সূর্যের চোখ”। তরুণ বয়সে এক সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করে তিনি চলে যান জাভা দ্বীপে, কিন্তু সংসারে সুখ পাননি। পরবর্তীতে ইউরোপে ফিরে এসে প্যারিসে গড়ে তোলেন নিজের নতুন পরিচয়—এক রহস্যময় পূর্বদেশীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে।

তার নৃত্যের ভঙ্গি, পোশাক ও উপস্থাপনায় এক ধরণের মায়াবী শক্তি ছিল। ইউরোপের রাজদরবার ও অভিজাত সমাজে তিনি হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও রাজকর্মচারীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, যা পরে তাকে “সেক্স স্পাই” তকমা এনে দেয়।

প্রেমের ফাঁদ, না রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গুপ্তচর আতঙ্ক। এই সময় মাতা হারির যাতায়াত ছিল জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে, তিন দেশই তখন যুদ্ধে জড়িত। ফলে তিনি স্বভাবতই সন্দেহের তালিকায় উঠে আসেন।

ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর ওপর নজরদারি শুরু করে। অভিযোগ ওঠে, তিনি নাকি জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা “অ্যাবভেয়ার”-এর হয়ে তথ্য আদানপ্রদান করতেন। আবার জার্মান সূত্র বলত, তিনি ফরাসিদের পক্ষেই কাজ করছিলেন। সত্য আসলে কোথায়, তা আজও রহস্য।

অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মাতা হারি হয়তো সত্যিকার গুপ্তচর ছিলেন না, বরং রাজনৈতিক খেলায় বলি হয়েছিলেন। তাঁর সৌন্দর্য ও খ্যাতিকে ব্যবহার করা হয়েছিল জনমত প্রভাবিত করার জন্য।

আদালতের নাটক ও মৃত্যুদণ্ড

১৯১৭ সালে ফ্রান্সের সামরিক আদালতে মাতা হারির বিচার শুরু হয়। প্রমাণের চেয়ে তার খ্যাতিই যেন ছিল সবচেয়ে বড় অভিযোগ। তাকে অভিযুক্ত করা হয় ২০ হাজার ফরাসি সৈন্যের মৃত্যুর কারণ হিসেবে, যদিও কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায়নি।

১৫ অক্টোবর ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের এক সামরিক ব্যারাকে ভোরবেলায় মাতা হারিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর সময় তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে কোনো ভয় ছিল না। মৃত্যুর পর তিনি হয়ে উঠলেন ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত নারী গুপ্তচর।

রহস্যের পর্দা আজও অমোচনীয়

পরবর্তীকালে প্রকাশিত কিছু নথি বলছে, মাতা হারি আসলে দ্বৈত চরিত্রে ছিলেন না; বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে তিনি ছিলেন এক ট্র্যাজিক চরিত্র—যিনি ক্ষমতাশালী পুরুষদের রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে ফ্রান্স সরকার তার মৃত্যুর ১০০ বছর পূর্তিতে আংশিকভাবে স্বীকার করে, প্রমাণের ঘাটতির কারণে মাতা হারিকে “ন্যায্য বিচার” দেওয়া হয়নি।

মাতা হারি শুধু এক নারীর গল্প নয়, এটি ইতিহাসের এক দৃষ্টান্ত, যেখানে ভালোবাসা, খ্যাতি ও রাজনীতি একত্রে গড়ে তুলেছিল এক মারণ ফাঁদ। তাঁর গল্প দেখিয়েছে, “সেক্স স্পাই” কৌশল শুধু তথ্যের খেলা নয়, এটি ক্ষমতারও নির্মম ব্যবহার।