Home Second Lead বিষের ছায়ায় কৃষি ও জনস্বাস্থ্য , নিয়ন্ত্রণহীন বালাইনাশকে হুমকির মুখে পরিবেশ

বিষের ছায়ায় কৃষি ও জনস্বাস্থ্য , নিয়ন্ত্রণহীন বালাইনাশকে হুমকির মুখে পরিবেশ

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, বাকৃবি, ময়মনসিংহ: দেশের কৃষিতে বালাইনাশকের নির্বিচার ব্যবহার এখন মারাত্মক একটি জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। মাঠপর্যায়ে নজরদারির দুর্বলতা, কৃষকের অনভিজ্ঞতা এবং বাজারে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নিম্নমানের রাসায়নিকের সহজলভ্যতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগ থাকলেও তা নিতান্তই সীমিত। ফলে পরিবেশ, জলজ প্রাণী, গবাদিপশু এবং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সবকিছুই ঝুঁকির মুখে।

গত ২৮ জুন এক সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার পরিস্থিতিকে “অতি উদ্বেগজনক” বলে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, অনেক এলাকায় আগাছানাশক ছিটিয়ে ঘাস নষ্ট করে গবাদিপশুকে খাওয়ানো হচ্ছে, যা খাদ্যচক্রে গুরুতর বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তাঁর অভিযোগ, “বিষ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে, গরু-ছাগল ঘাস খেতে পারছে না। দেশের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে।” তিনি বালাইনাশক নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ বালাইনাশক ব্যবহার হচ্ছে এবং যেভাবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে—তাতে পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল জানান, “বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ছত্রাকনাশক, মোট ব্যবহারের প্রায় ৪৫ থেকে ৪৬ শতাংশ। ৩০ শতাংশ সবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক।”

তাঁর মতে, ভুল মাত্রায় ব্যবহার, একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ এবং ডিলারনির্ভর জ্ঞান কৃষকদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, “অনেক কৃষক স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও সঠিক তথ্যের অভাবে অনুমাননির্ভরভাবে বালাইনাশক প্রয়োগ করেন। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।”

বালাইনাশক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নীতিমালার দুর্বল বাস্তবায়নকেও প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি। বাজারে চোরাই পথে আসা নিম্নমানের রাসায়নিক সহজেই বিক্রি হচ্ছে, অথচ কার্যকর মনিটরিং নেই বললেই চলে। অধ্যাপক মঞ্জিলের মতে, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম), জৈব বালাইনাশক, ট্রাইকোডারমা এবং বিকল্প প্রযুক্তি জনপ্রিয় করতে সরকারের ভর্তুকি ও গণমাধ্যমভিত্তিক প্রচারণা জরুরি।

এদিকে, পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ চিত্র রয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতে। ভেটেরিনারি অনুষদের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ গবাদিপশুর দুধ, মাংস ও শরীরে জমে মানুষের স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি তৈরি করছে। তিনি বলেন, “বালাইনাশকের লিপিড-আকর্ষণশীল উপাদানগুলো শরীর থেকে সহজে বের হয় না। এগুলো ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস এবং ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করার মতো দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করে।”

তিনি সতর্ক করেন, ঘাস উৎপাদনে আগাছানাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার এখন দেশের অনেক অঞ্চলে সাধারণ চিত্র। ফলে পশুর খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সরাসরি প্রাণীর শরীরে ঢুকছে। এর প্রভাব হিসেবে দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া, পশুর রোগপ্রবণতা বৃদ্ধি এবং মাংসে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি দেখা দিচ্ছে।

গবেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য উভয়ই ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে। তাঁরা দ্রুত গবেষণা তহবিল বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রণোদনা এবং মাঠপর্যায়ে তদারকি জোরদারের সুপারিশ করেছেন।

দুই বিশেষজ্ঞের মতে, এখনই নীতিনির্ধারকরা কঠোর পদক্ষেপ না নিলে বালাইনাশকের বিষাক্ত স্রোত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য—সবকিছুকেই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে ঠেলে দেবে।