Home Third Lead মাটির কলসি থেকে প্লাস্টিকের যুগ: পালপাড়ার শিল্পীদের হারানো সময়

মাটির কলসি থেকে প্লাস্টিকের যুগ: পালপাড়ার শিল্পীদের হারানো সময়

মো:সোহেল রানা, ঠাকুরগাঁও:  সদর উপজেলার ঢোলারহাট ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রাম। চারদিকে নিস্তব্ধতার চাদর মাখা এই শান্ত গ্রামটিকে বহু বছর ধরে চিনিয়ে এসেছে একটি বিশেষ পরিচয়, কুমোর পল্লি। এখানে মাটির গায়ে হাত বুলিয়ে শিল্প সৃষ্টি করা শুধু পেশা নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালিত এক উত্তরাধিকার। কিন্তু সময়ের কঠিন বাস্তবতায় সেই ঐতিহ্য আজ টিকে থাকার লড়াইয়ে জর্জরিত, যেন নিভু নিভু শিখার মতো দুলছে অস্তিত্বের সীমারেখায়।

কুমোরদের ভাষায়, একসময় এই গ্রামে মাটি ছিল আশীর্বাদের মতো। নদীর তলদেশ বা আশপাশের উর্বর জমি থেকে ২০ ফুট নিচের লালচে মাটি তুলে এনে শুরু হতো সৃজনশীলতার প্রথম ধাপ। নরম মাটিকে বারবার গুঁড়ো করা, ছেঁকে নেওয়া, জল মিশিয়ে পরিপক্ব করা—অসংখ্য ধাপের পর যেই মাটি চাকার ঘূর্ণনে শিল্পীর আঙুলের ছোঁয়ায় রূপ নিত হাঁড়ি, পাতিল, কলস, ঢাকনা, শোভা সামগ্রীতে। প্রতিটি তৈজসপত্র যেন তাদের পরিশ্রম আর মমতার স্বাক্ষর বহন করত।

কিন্তু সেই স্বপ্নমাখা দিনের পাতা এখন মলিন। সুব্রত পাল বলেন, বাজারে প্লাস্টিক, স্টিল ও দস্তার তৈজসপত্র ঢুকে পড়ায় মাটির জিনিস মানুষ ভুলে যাচ্ছে। একসময় যেসব কলসিতে জল ঠান্ডা থাকত, যেসব হাঁড়িতে ভাতের গন্ধ অন্যরকম হতো—আজ সেসব স্মৃতি হয়ে গেছে। ফলে কুমোরদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগের মতো বিক্রি নেই, চাহিদাও নেই। তাই এই পেশায় টিকে থাকা ক্রমেই দুরূহ।

মহন্ত পালের কথায় উঠে আসে গভীর হতাশা। তার চোখে এখনো লেগে আছে পুরোনো দিনের দৃশ্য, যখন পালপাড়ায় ৫০টিরও বেশি পরিবার চাকার ঘূর্ণনে জীবিকার আলো পেত। অথচ এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬টি পরিবারে। সরকারি সহায়তার অভাবে বহু কারিগর পেশা বদলে অন্যত্র চলে গেছেন। গ্রামের সন্ধ্যাতেও তাই আর শোনা যায় না চাকা ঘোরানোর সেই পরিচিত শব্দ।

জয়ন্ত পাল আশার আলো দেখান। তিনি মনে করেন, যদি স্বল্প সুদে ঋণ, নিয়মিত মেলা ও প্রদর্শনী এবং সরকারি অনুদানের সুযোগ পাওয়া যায়, তবে এই শিল্প আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। কারণ মাটির সঙ্গে যে সম্পর্ক, তা কখনো পুরোপুরি ভেঙে যায় না।

ঠাকুরগাঁও বিসিক জেলা কার্যালয়ের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আরমান আলী জানান, মৃৎশিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে তারা প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা এবং প্রচারে কাজ করছেন। পালপাড়ার দুইজন কারিগর ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ পেয়েছেন বলে জানান তিনি। বাইরে থেকে মাটি সংগ্রহে সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন।

তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়—সময়ের এই নিষ্ঠুর স্রোত কি পালপাড়ার ঐতিহ্যকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে?
কাঁচামাল সংকট, বাজার প্রতিযোগিতা আর তরুণ প্রজন্মের বিমুখতা—এই তিনের চাপে ঠাকুরগাঁওয়ের কুমোর পল্লির মৃৎশিল্প আজ অস্তিত্ব সংকটে। দ্রুত উদ্যোগ না নিলে বিলীন হয়ে যেতে পারে এই অমূল্য ঐতিহ্য, হারিয়ে যেতে পারে মাটির গন্ধে জন্ম নেওয়া একটি শিল্পের ইতিহাস।