Home সারাদেশ মায়ের জিজ্ঞাসা “রাফি কেমন আছে?”-যার উত্তর নেই হাসপাতালে

মায়ের জিজ্ঞাসা “রাফি কেমন আছে?”-যার উত্তর নেই হাসপাতালে

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: রাজধানী ঢাকায় শুক্রবার সকালে ভূমিকম্পের আকস্মিক ঝাঁকুনিতে থমকে যায় বহু মানুষের জীবন। সেই থমকে যাওয়া মুহূর্তেই থেমে যায় বগুড়ার ছেলে, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাফির জীবনও।

রাফির গ্রামের বাড়ি বগুড়া। দুই ভাইবোনের পরিবার। বাবা চাকরি করেন দিনাজপুরে। হলে সিট পেলেও রাফি ঢাকায় মায়ের এবং বোনের সঙ্গে থাকতেই স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নের পথচলায় পরিবারই ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি।

শুক্রবার সকালটাও ছিল একেবারে স্বাভাবিক। মা-ছেলে বের হয়েছিলেন বাজারে। বংশালের কসাইতুলির নয়নের মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। এমন সময় হঠাৎ শুরু হয় ভূমিকম্প। মুহূর্তেই চারপাশ কেঁপে ওঠে। মানুষজন দিশেহারা। ঠিক তখনই দোকানের উপরের অংশ থেকে বড়সড় রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে। ভীড়ে ভরা রাস্তায় ঘটনার সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যে কেউ বুঝে ওঠার সুযোগও পায়নি।

দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফি এবং তার মা আহত হন। এলাকাবাসী দৌড়ে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসকেরা জানান, রাফিকে আর বাঁচানো যায়নি। তরুণ চিকিৎসা শিক্ষার্থীর অকাল বিদায়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তার সহপাঠী, পরিবার, পরিচিতজনরা।

রাফির মা গুরুতর আহত অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারে। তার চিকিৎসা চলছে। তিনি শারীরিকভাবে স্থিতিশীল হলেও মানসিকভাবে চরম ট্রমার মধ্যে আছেন। ছেলের মৃত্যুর খবর এখনো তাকে জানানো হয়নি। ব্যথার ঝাঁকুনির মধ্যেও তিনি বারবার জিজ্ঞাসা করছেন, “রাফি কেমন আছে?” হাসপাতালের কোলাহল, করিডোরের আলো, চিকিৎসকদের ব্যস্ততা—সবকিছুর মধ্যেই কেবল এক মায়ের অসহায় প্রশ্ন। কেউ বলতে পারছে না তাকে সেই কঠিন সত্য কথা, যা শুনলে হয়তো তার পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না।

এদিকে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছেন রাফির একমাত্র বোন। ভাইয়ের মরদেহ আর মায়ের যন্ত্রণার দৃশ্য তাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে শেষবার কথা বলার মুহূর্তটাও ছিল একেবারে সাধারণ, আর সেই সাধারণ মুহূর্তই এখন স্মৃতির ভারে অসহনীয় হয়ে উঠেছে তার কাছে।

পুলিশ জানায়, বংশালের কসাইতুলিতে পাঁচতলা ভবনের অংশবিশেষ ভেঙে পড়ে তিনজন পথচারী নিহত হন। তাদেরই একজন রাফি। বাকি দুইজনের পরিচয় এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি।

ভূমিকম্পটি সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে অনুভূত হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী এলাকা, রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫.৭। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভবন হেলে পড়া, দেয়ালে ফাটল দেখা দেওয়াসহ নানান ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।

রাফির সহপাঠীরা বলছেন, মানুষের সেবা করার স্বপ্ন ছিল তার। হাসিখুশি, মনোযোগী, পরিবারপ্রিয় একটি ছেলে সকালে বাজারে গিয়ে যে আর ফিরে আসবে না—তারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না।

ঢাকার ব্যস্ত শহরে প্রতিদিনই অসংখ্য গল্প জন্ম নেয়, আবার নিভেও যায়। কিন্তু রাফির গল্পটি যেন অন্যরকম। কারণ সেই গল্পে রয়েছে এক মায়ের প্রশ্ন, যার কোনো উত্তর পৃথিবীর আলোয় নেই। রয়েছে এক বোনের শোক, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। এবং রয়েছে এক তরুণের অসমাপ্ত স্বপ্ন, যার গন্তব্য এখন চিরদিনের জন্য থেমে গেছে একটি ভেঙে পড়া রেলিংয়ের নিচে, এই শহরের বিশৃঙ্খল কোনো এক বাজারের রাস্তায়।