বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এই বিশাল অঙ্ক আর্থিক খাতের নড়বড়ে অবস্থাকে উন্মোচিত করার পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আঁতকে ওঠার মতো পরিসংখ্যান
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি অর্থ। অথচ, ২০২৫ সালের জুন প্রান্তিক শেষেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে (জুন-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
বর্ষভিত্তিক পর্যালোচনায় চিত্রটি আরও ভয়াবহ। গত বছরের (২০২৪) সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় যেখানে মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, সেখানে দেড় দশকে তা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে।
কেন এই উল্লম্ফন?
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এবং অর্থনীতিবিদরা খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন:
১. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও নতুন নীতিমালা: আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঋণ খেলাপি হওয়ার নিয়ম কঠোর করা হয়েছে। আগে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯ মাস পর খেলাপি করা হতো। এখন মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস পর অর্থাৎ ৯০ দিন কিস্তি না দিলেই তাকে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
২. অনিয়ম ও জালিয়াতি: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, যার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ওইসব ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন ভেসে উঠছে।
৩. কঠোর নজরদারি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে নজরদারি জোরদার করায় ব্যাংকগুলো আর আগের মতো প্রকৃত তথ্য গোপন করতে পারছে না। আগে যেসব ঋণ কাগজে-কলমে ‘নিয়মিত’ দেখানো হতো, সেগুলো এখন মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
খাতভিত্তিক চিত্র ও আইএমএফের শর্ত
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশের মতো এখন খেলাপি। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে তা ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া বিগত সময়ে ব্যাপক অনিয়মের শিকার ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যাংকে ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, “খেলাপি ঋণ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধায় পড়েন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো লেনদেন ফি বাড়িয়ে দেয়। দেশকে অবশ্যই এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে এবং ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”
ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ
এদিকে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ পুনঃতফসিলের মেয়াদ ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আওতায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ পাবেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।










