ধারাবাহিক রোমান্টিক গল্প
সময়ের শেষে দাঁড়িয়ে, বোঝাপড়ার শুরু
স্মৃতি হাসান
কলেজ প্রাঙ্গণে রাত নেমে এসেছে ধীরে ধীরে। দিনের কোলাহল থেমে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে এক ধরনের শান্তি, যা শুধু সন্ধ্যার পরই অনুভব করা যায়। পুরনো ভবনের বারান্দায় আলো জ্বলছে, দূরে ক্রিকেট মাঠের লাইটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পথের ওপর শুকনো পাতা নরম শব্দ করে পড়ে থাকে। এই স্থিরতার মাঝেই তারা দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল—পরস্পরের সঙ্গে নয়, বরং নিজের নিজের ভাবনার সঙ্গে।
গত কয়েক দিনের ভুল বোঝাবুঝি, মনখারাপ, অপ্রকাশিত অনুভূতি—সবকিছু নীরবতার মধ্যে ভেসে উঠছিল। কখনো কখনো এমন হয় যে কোনো কথাই ঠিকভাবে বলা যায় না, আবার না বললেও বোঝা হয়ে যায়। তাদের মধ্যেও ঠিক সেইরকমই এক অবস্থা।
ছেলেটি আগে থামল। তার মুখভঙ্গি খুব স্থির, কিন্তু চোখে ক্লান্তির ছাপ আছে। মেয়েটি একটু দেরিতে থামল। দুজনেই বুঝল, আর এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কথা বলা দরকার।
মেয়েটি ধীরে বলল যে তার নিজের ভেতর একটা চাপ তৈরি হয়েছিল; পড়াশোনা, পরিবার, নিজের ভবিষ্যৎ—সব মিলিয়ে সে গুটিয়ে গিয়েছিল। সে কারও ওপর রাগ করেনি, কিন্তু নিজেরই ভেতরে আটকে গিয়েছিল। ছেলেটি মন দিয়ে তার কথা শুনল। সে বলল, সে শুধু চেয়েছিল মেয়েটি যেন স্বচ্ছন্দ থাকে; সে চাইনি তাকে কোনো সিদ্ধান্তে বা কোনো অনুভূতিতে ঠেলে দিতে।
তাদের কথায় কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং ছিল গ্রহণযোগ্যতা। এই গ্রহণযোগ্যতাই ধীরে ধীরে তাদের দুজনকে শান্ত করে দিল।
মেয়েটি বলল, দূরে থাকা মানেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া নয়; কখনো কখনো দূরত্বও মানুষকে বড় করে। ছেলেটি মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে জানত, সব সম্পর্কেরই সময় লাগে, এবং সব সম্পর্ক একইভাবে থাকে না। কখনো কাছাকাছি আসে, কখনো দূরে সরে যায়—তবু তার মানে এই নয় যে সম্মান বা যত্ন কমে যায়।
দুজনেই জানত, তারা জীবনের এমন এক বয়সে আছে যখন অনেক সিদ্ধান্তই অনিশ্চিত, অনেক অনুভূতিই অস্থির। তাই একে অপরের স্বাধীনতাকে মানিয়ে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো পথ। বিদায়ের মুহূর্তে তারা কোনো প্রতিশ্রুতি দিল না; বরং নরমভাবে বলল, প্রয়োজনে পাশে থাকবে, আর না হলে দূরত্বকেও সম্মান করবে।
মেয়েটি যখন করিডোরের দিকে হাঁটা শুরু করল, বাতাসে তার চুল একটু নড়ল। ছেলেটি পিছন থেকে তাকিয়ে রইল না; বরং অন্যদিকে চোখ ফেরাল, যেন বোঝাতে চাইছে, সবকিছুরই নিজের মতো চলার সময় আছে। তারা দুজনই নিজেদের মতো করে বড় হচ্ছে, এবং সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাত তখন আরও গভীর। দূরের ঘড়িঘরের ঘণ্টা বাজে। কলেজের পুকুরে চাঁদের আলো স্থিরভাবে পড়ে থাকে। শান্ত পরিবেশ যেন তাদের গল্পের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই শেষ পর্ব কোনো নাটকীয় সমাপ্তি নয়; বরং এক নিঃশব্দ উপলব্ধি—সব অনুভূতি শব্দে বলা যায় না, আবার সব সম্পর্কের শেষ মানেই শেষ নয়।
শেষটা তাই স্থির, নরম, বাস্তব।
তারা একই পথ ধরে হাঁটেনি, কিন্তু একই বোঝাপড়ার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
এটাই তাদের শেষ পর্ব—আর শুরুও বটে।










