চিংড়িঘেরের গ্রাসে বিপন্ন উপকূলীয় রক্ষাকবচ
আমিরুল মোমেনিন, সাতক্ষীরা: একসময় যেখানে ছিল ঘন কেওড়া, গেওয়া আর বাইন গাছের সারি, সেখানে এখন থৈ থৈ নোনাজল। বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে, বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি চাষের ধুম পড়েছে। আর এই চিংড়িঘের তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বন। কৃত্রিমভাবে নোনাপানি ঢুকিয়ে বনভূমিকে জলাশয়ে রূপান্তরের এই আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় ধুঁকছে উপকূলের পরিবেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক এই রক্ষাকবচ ধ্বংসের ফলে উপকূলীয় জনপদ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
সরেজমিন চিত্র: সবুজের বদলে নোনাজলের মরুভূমি
সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও খুলনার কয়রা উপজেলার উপকূলবর্তী এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে এক ভয়াবহ দৃশ্য। বেড়িবাঁধের পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট-বড় হাজারো চিংড়িঘের। স্থানীয়রা জানান, প্রভাবশালী ঘের মালিকরা রাতের আঁধারে ম্যানগ্রোভ বন কেটে জমি দখল করছেন। এরপর বাঁধ ছিদ্র করে জোয়ারের নোনাপানি সেখানে ঢোকানো হচ্ছে।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের প্রবীণ বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, “দশ বছর আগেও এই চরে জঙ্গল ছিল, বাঘের ভয় ছিল। এখন মাইলের পর মাইল শুধু ঘের। নোনাপানিতে সব গাছ মরে গেছে। এখন ঝড় আইলে আটকানোর কিছু নাই।”
অনুসন্ধানে উঠে আসা কুফল
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বহুমুখী বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে:
১. লবণাক্ততার বিস্তার ও কৃষি ধ্বংস: চিংড়ি চাষের জন্য দীর্ঘসময় জমিতে নোনাপানি আটকে রাখা হয়। এই লবণাক্ততা চুইয়ে পাশের ফসলি জমিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ধান বা সবজি চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মাটিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালাও মরে যাচ্ছে।
২. বাঁধের ক্ষতি ও ভূমিক্ষয়: ঘেরের জন্য অবৈধভাবে পাইপ বসিয়ে বেড়িবাঁধ ছিদ্র করা হয়। এতে বাঁধ দুর্বল হয়ে যায় এবং জলোচ্ছ্বাসে সহজেই ভেঙে প্লাবিত হয় লোকালয়। এছাড়া ম্যানগ্রোভের শেকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে। বন উজাড় হওয়ায় ভূমিক্ষয় বা নদীভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
৩. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস: ম্যানগ্রোভ বন বহু প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এবং প্রজননকেন্দ্র। বন ধ্বংস হওয়ায় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।
সুরক্ষায় ম্যানগ্রোভ কেন অপরিহার্য?
পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, ম্যানগ্রোভ বন উপকূলের জন্য ‘প্রাকৃতিক দেয়াল’ বা ‘শক অ্যাবজরবার’ হিসেবে কাজ করে।
দুর্যোগ মোকাবিলা: সিডর, আইলা বা আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময় দেখা গেছে, সুন্দরবন বা ম্যানগ্রোভ বেষ্টনী বাতাসের গতিবেগ ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। যেখানে বন নেই, সেখানে জলোচ্ছ্বাস সরাসরি আঘাত হানে।
কার্বন শোষণ: সাধারণ বনের তুলনায় ম্যানগ্রোভ বন চারগুণ বেশি কার্বন শোষণ করতে পারে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে সহায়ক।
বিশেষজ্ঞ মতামত
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের একজন অধ্যাপক বলেন, “আমরা সাময়িক অর্থের লোভে দীর্ঘমেয়াদি বাজি ধরছি। চিংড়ি রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। ম্যানগ্রোভ না থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসে এই জনপদ মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে।”
করণীয় কী?
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, এখনই চিংড়ি চাষের জন্য নির্দিষ্ট জোন বা এলাকা নির্ধারণ করে দিতে হবে। উপকূলীয় বনায়ন বা ম্যানগ্রোভ এলাকার আশেপাশে নোনাপানি ঢোকানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ফের উপকূলকে সবুজ বেষ্টনীতে মুড়িয়ে দেওয়া ছাড়া এই আসন্ন বিপর্যয় থেকে বাঁচার কোনো বিকল্প নেই।
চিংড়ি সম্পদ, কিন্তু সুন্দরবন ও ম্যানগ্রোভ জীবন। উপকূলের লাখো মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে ‘সাদা সোনা’র মোহ ত্যাগ করে সবুজ রক্ষায় কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা এখনই জরুরি। অন্যথায়, সাগরের নোনাজল একদিন গ্রাস করে নেবে পুরো উপকূলীয় সভ্যতা।










