চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের নাম রোবোটিক সার্জারি। শল্যচিকিৎসকের হাতের নিখুঁত চালনা আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে জটিল সব অস্ত্রোপচার এখন হয়ে উঠেছে অনেক বেশি নিরাপদ ও সহজ।
উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি এশিয়ার অনেক দেশেও এখন স্ত্রীরোগ (গাইনোকোলজি), ইউরোলজি এবং ক্যানসার চিকিৎসায় রোবোটিক সার্জারি নিয়মিত আস্থার জায়গা করে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর ব্যাপক প্রসারের বিপরীতে বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জল্পনা-কল্পনা ও প্রস্তুতি।
সাধারণ অস্ত্রোপচারের চেয়ে রোবোটিক সার্জারি কেন আলাদা—তা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই। এতে চিকিৎসকের সরাসরি হাতের স্পর্শ ছাড়াই অত্যাধুনিক ‘রোবোটিক আর্ম’ বা যান্ত্রিক বাহু ব্যবহার করা হয়। সার্জন একটি বিশেষ কনসোলে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনে রোগীর শরীরের ভেতরের অংশ দেখেন এবং নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ মেনেই রোবটের যান্ত্রিক বাহু অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে রোগীর শরীরে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির চেয়ে এটি অনেক বেশি নির্ভুল। মানুষের হাত অনেক সময় অজান্তেই কেঁপে উঠতে পারে, কিন্তু রোবটের যান্ত্রিক বাহুতে সেই ‘হিউম্যান এরর’ বা ভুলের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বিশেষ করে স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে বিশ্বজুড়ে রোবোটিক সার্জারির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চিকিৎসকরা এর প্রধান তিনটি সুবিধার কথা উল্লেখ করেছেন:
১. অত্যন্ত নিখুঁত (Precision): রোবটের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার হওয়ায় মানুষের হাতের কাঁপুনি বা সামান্যতম বিচ্যুতির সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায় থাকে। ফলে স্পর্শকাতর অঙ্গের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কমে।
২. দ্রুত আরোগ্য (Faster Recovery): এতে রোগীর শরীরে খুব ছোট ছিদ্র করতে হয়। ফলে রক্তক্ষরণ অত্যন্ত কম হয়, ব্যথা কম হয় এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারেন।
৩. থ্রি-ডি ভিউ (3D Visualization): সার্জন কনসোলে বসে রোগীর শরীরের ভেতরের অংশ হাই-ডেফিনিশন থ্রি-ডি পর্দায় দেখতে পান, যা দ্বিমাত্রিক বা সাধারণ দৃষ্টির চেয়ে অনেক স্বচ্ছ ধারণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের দেশগুলোতে রোবোটিক সার্জারি এখন ‘স্ট্যান্ডার্ড অব কেয়ার’-এ পরিণত হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং সম্প্রতি ভিয়েতনামেও এই প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অ্যাপোলো বা ফোর্টিস-এর মতো হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত রোবোটিক সার্জারি হচ্ছে, যার বড় একটি অংশের রোগী বাংলাদেশি। ভিয়েতনামে সম্প্রতি একজন নারী সার্জনের নেতৃত্বে রোবোটিক গাইনি সার্জারির সাফল্য প্রমাণ করে যে, এই প্রযুক্তি এখন আর কেবল পশ্চিমা বিশ্বের একচেটিয়া নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বেশ জনপ্রিয় এবং সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। তবে রোবোটিক সার্জারি পুরোদমে চালু হওয়া এখন সময়ের দাবি। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এই প্রযুক্তি আনার পরিকল্পনা করছে।
দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে রোবোটিক সার্জারি চালু হলে বিদেশমুখী রোগীর স্রোত কমবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে। তবে এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তির উচ্চমূল্য এবং দক্ষ জনবল তৈরি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ সার্জন বিজনেসটুডে২৪-কে বলেন, “আমাদের দেশের সার্জনরা অত্যন্ত দক্ষ। ল্যাপারোস্কোপিতে আমরা বিশ্বমানের সেবা দিচ্ছি। রোবোটিক সার্জারি বা ‘ডা ভিঞ্চি সিস্টেম’ এর মতো প্রযুক্তি দেশে আসলে আমাদের চিকিৎসকরা দ্রুতই তা আয়ত্ত করতে পারবেন। এতে রোগীদের ভারত বা সিঙ্গাপুর যাওয়ার ভোগান্তি ও খরচ—দুটোই কমবে।”
প্রযুক্তিবিদ ও চিকিৎসকরা আশা করছেন, ২০২৫-২৬ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোবোটিক সার্জারি একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হবে।










