Home সারাদেশ কুয়াশাভেজা ভোরে সুবাস ছড়াচ্ছে ‘ফুলের রাজধানী’ গদখালি

কুয়াশাভেজা ভোরে সুবাস ছড়াচ্ছে ‘ফুলের রাজধানী’ গদখালি

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, যশোর: শীতের শিশিরভেজা ভোরে যখন কুয়াশার চাদর মোড়ানো থাকে চরাচর, ঠিক তখনই হাজারো ফুলের সুবাসে জেগে ওঠে যশোরের এক নিভৃত জনপদ। দিগন্তজোড়া মাঠে লাল, নীল, হলুদ আর সাদা রঙের মেলা। বাতাসে ভাসে গোলাপ, রজনীগন্ধা আর গ্লাডিওলাসের মিষ্টি ঘ্রাণ। এটি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি, যাকে এখন একনামে সবাই চেনে বাংলাদেশের ‘ফুলের রাজধানী’ হিসেবে।

সৌন্দর্যপিপাসুদের মনের খোরাক মেটানোর পাশাপাশি এই জনপদ এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে গদখালির চাষিরা বুনছেন নতুন স্বপ্ন। আসন্ন পাঁচটি বিশেষ দিবসকে ঘিরে এখানকার বাতাসে এখন ১০০ কোটি টাকার বাণিজ্যের সুবাস।

৪০০ কোটি টাকার রঙিন অর্থনীতি
একসময় যে জমিতে কেবল ধান আর পাটের আবাদ হতো, সেখানে আজ দেড় হাজার হেক্টরজুড়ে দুলছে বিচিত্র সব ফুল। গদখালিসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় ছয় হাজার চাষি এখন ফুল চাষের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি অফিস ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গদখালির এই ফুলের রাজ্য এখন বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বাজারে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে বসে দেশের বৃহত্তম ফুলের মোকাম। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকাররা ভিড় জমান এখানে। দর কষাকষির হট্টগোল আর ফুলের গন্ধে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এখান থেকেই ট্রাকভর্তি ফুল ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়।

বিপ্লবের নায়ক শের আলী ও বর্তমান চিত্র
গদখালির এই ফুল বিপ্লবের শুরুটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। ১৯৮২ সালে পানিসারা গ্রামের কৃষক শের আলী সরদার মাত্র এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা চাষের মাধ্যমে এই স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন। তাঁর সেই ছোট্ট উদ্যোগ আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এখন এখানে শুধু রজনীগন্ধাই নয়; চাষ হচ্ছে গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, অর্কিড, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা জাতের ফুল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পলি হাউজে চাষ হচ্ছে উচ্চমূল্যের জারবেরা।

চাষিদের আশা ও আশঙ্কা
সামনেই মহান বিজয় দিবস, ইংরেজি নববর্ষ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বসন্তবরণ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই পাঁচ দিবসই ফুল চাষিদের মূল টার্গেট। গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর জানান, “মৌসুমের এই পাঁচটি দিবসকে ঘিরে আমরা ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা করছি। শীতের শুরু থেকেই বাজার জমতে শুরু করেছে।”

তবে কৃষকদের মনে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কুলাউড়া গ্রামের চাষি আরিজুল ইসলাম বলেন, “এবার রজনীগন্ধার রেকর্ড দাম পেয়েছি। এক বিঘা জমিতে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি।” অন্যদিকে পটুয়াপাড়া গ্রামের চাষি তৈয়ব আলীর কণ্ঠে কিছুটা হতাশা, “গোলাপের সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কিছুটা কমেছে। তবে আশা করছি বিজয় দিবসের আগে দাম বাড়বে।”

চাষি সাইফুল ইসলাম ও ইসমাইল হোসেনের মতে, বর্ষায় অনেক গাছ নষ্ট হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে কিছুটা ধাক্কা খেতে হয়েছে। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও লাভের মুখ দেখবেন বলে আশাবাদী তারা।

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
গদখালির ফুল কেবল বাণিজ্যের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন পর্যটনের এক নতুন কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় করছেন ফুলের রাজ্য দেখতে। ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন, “চাষিরা যাতে রোগবালাইমুক্ত ভালো ফলন পান, সেজন্য আমরা সবসময় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। গদখালির ফুলচাষিরা এবারও লাভবান হবেন বলে আশা করছি।”

অনলাইন ফুল সরবরাহ উদ্যোক্তা মো. আল আমিন বলেন, “ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেও এখন গদখালির ফুল পৌঁছে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। ফুলের এই রাজধানী এখন নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখছে, আর সেই স্বপ্নে রঙিন হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।