Home First Lead ভোটের মাঠে উত্তাপ: মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে নারী

ভোটের মাঠে উত্তাপ: মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে নারী

আমিরুল মোমেনিন,ঢাকা: দেশজুড়ে এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ। ছোট-বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছে, চলছে বিরামহীন গণসংযোগ। ৩০০ আসনের বিপরীতে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তৎপরতায় রাজনীতি এখন তুঙ্গে। তবে উৎসবমুখর এই পরিবেশের আড়ালে প্রার্থী তালিকার একটি ভিন্ন চিত্র সামনে এসেছে, যা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ চরিত্র নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। মনোনয়ন তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের অনীহা ও বৈষম্য বিরাজ করছে।

নারীর অংশগ্রহণ: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিশাল ফারাক
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এটি সরাসরি সংসদ সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়, তবুও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অন্তত ১৫-২০ শতাংশ নারী প্রার্থী প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী:

বিএনপি: দেশের অন্যতম প্রধান এই দলটি ২৭৩টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে নারী প্রার্থীর সংখ্যা মাত্র ১১ জন। শতাংশের বিচারে যা অত্যন্ত নগণ্য। দলটির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শক্তিশালী নারী নেতৃত্ব থাকলেও, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে নারীদের ওপর আস্থার সংকট স্পষ্ট।

এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি): তুলনামূলক নতুন বা ছোট দল হয়েও এনসিপি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের ঘোষিত ১২৫টি আসনের মধ্যে ১৪ জন নারী মনোনয়ন পেয়েছেন। বিশ্লেষকরা একে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার’ প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন।

জামায়াত ও সমমনা জোট: জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী তালিকায় এখন পর্যন্ত কোনো নারীর নাম নেই। আধুনিক বা প্রগতিশীল রাজনীতির মানদণ্ডে এই ‘শূন্য’ কোটা বড় ধরনের উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দলগুলো নারীদের জন্য ‘নিরাপদ আসন’ ছাড়তে নারাজ। কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পুরুষ প্রার্থীদের ওপরই ভরসা রাখছে হাইকমান্ড, ফলে সংসদে নারীর প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে।

সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব: এনসিপির চমক বনাম গতানুগতিক ধারা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ঐতিহ্যগতভাবে ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে দেখা হলেও, আইনপ্রণেতা হিসেবে তাদের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে বরাবরই রক্ষণশীলতা লক্ষ্য করা যায়। ত্রয়োদশ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

অধিকাংশ বড় দল যখন কৌশলগত কারণে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিতে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন এনসিপি সাতজন সংখ্যালঘু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। অন্যদিকে, আদর্শিক জায়গা থেকে রক্ষণশীল দল জামায়াতে ইসলামী খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দী নামে সনাতন ধর্মের একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে এবং আরও দু-একটি আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে। তবে সামগ্রিক বিচারে জোটগতভাবে এই সংখ্যা নগণ্য, যা সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বোধ করার কারণ হতে পারে।

দলীয় ব্যাখ্যা ও বাস্তবতা
জামায়াতে ইসলামী ও তাদের জোটের নারী প্রার্থী না থাকা প্রসঙ্গে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, “নারীদের প্রার্থী করার বিষয়টি এখনো আমাদের আলোচনার টেবিলে আছে। তবে সাংগঠনিক নিয়মনীতি এবং অনেক নারী কর্মীর নির্বাচনে অনাগ্রহের কারণে আমাদের জন্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। এটি আমাদের দলের জন্য একটি নতুন দিক।”

গণতন্ত্র কেবল ভোটের সংখ্যা নয়, বরং সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রাথমিক মনোনয়ন চিত্র প্রমাণ করছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নারী ও সংখ্যালঘুদের মূলধারার নেতৃত্বে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বহু যোজন পিছিয়ে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ ও রাষ্ট্র গঠনে দলগুলোর এই মানসিকতার পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।