তরল সোনায় শাহবাজ় সরকারের সঙ্গে ‘মেগা চুক্তি’তে পুতিন
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক: ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া, সম্প্রতি পাকিস্তানের সাথে তেল চুক্তি করার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ ঔরঙ্গজ়েব গণমাধ্যমকে বলেছেন যে রাশিয়ার সাথে তাদের খনিজ তেলের একটি বড় সমঝোতা হতে চলেছে। এই খবর ভারতের কূটনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। একদল কূটনীতিক একে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন, অন্যদিকে বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন এটি ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ফল।
রুশ-পাক তেল চুক্তির সম্ভাবনা:
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ ঔরঙ্গজ়েব ১৬ ডিসেম্বর সংবাদ সংস্থা আরআইএ-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, রাশিয়া যদি তরল সোনার ভান্ডারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাথে সমঝোতা করে, তবে তারা খুশি হবেন। বর্তমানে দুই দেশের জ্বালানি মন্ত্রকের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। ইসলামাবাদ ক্রেমলিনের সাথে হাত মিলিয়ে তরল সোনার অনুসন্ধান, উৎপাদন এবং পরিশোধনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর সহযোগিতা চাইছে। রুশ জ্বালানিমন্ত্রী সের্গেই সিভিলেভও নভেম্বরে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান একটি খনিজ তেল পরিশোধনাগার উন্নত করার জন্য ক্রেমলিনের একাধিক সংস্থার সাথে আলোচনা চালাচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা নাকি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা?
অনেকেই এই রুশ-পাক ঘনিষ্ঠতাকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। বিশেষত, যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানকে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার প্রবাহও পাকিস্তানে বাড়ছে।
তবে, বিশ্লেষকদের অন্য একটি অংশ এই মতের সঙ্গে একমত নন। তাদের যুক্তি, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে, ফলে তাদের বিকল্প বাজার খোঁজা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান তার ৮৫ শতাংশেরও বেশি খনিজ তেল আমদানি করে এবং এই খাতে খরচ কমানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। তাই উভয় দেশই নিজেদের স্বার্থে কাছাকাছি এসেছে। ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা শুরু করেছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের পার্শ্ববৈঠকেও বাণিজ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল।
মার্কিন প্রভাব এবং পাকিস্তানের দ্বিধা:
তবে, জ্বালানি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রুশ-পাক ‘কৌশলগত অংশীদারি’ কতটা মজবুত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সীমাহীন’ প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ২০২২ সালে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ক্রেমলিন সফরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরু হয়, যা ওয়াশিংটন ভালোভাবে নেয়নি। এর কিছুদিন পরেই ইমরান খান ক্ষমতা হারান।
বর্তমানে, পাকিস্তানের সামরিক প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে সচেষ্ট। সম্প্রতি মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা জানিয়েছে যে, তারা পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর এফ-১৬ যুদ্ধবিমান আধুনিকীকরণের জন্য ৬৮ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার মূল্যের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ১২৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে এবং আইএমএফ সম্প্রতি পাকিস্তানকে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, রাশিয়া থেকে বড় তেল চুক্তি করে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভের মুখে পড়তে চাইবে না বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। ওয়াশিংটন কোনো আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে থাকা পাকিস্তানের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তাছাড়া, ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে অন্ধকারে রেখে শাহবাজ় সরকার মস্কোর সাথে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে বলে মনে হয় না।
ভারতের ওপর প্রভাব:
২০২২ সাল থেকে ভারত রাশিয়া থেকে ব্যাপক সস্তায় তেল কিনছিল। তবে এ বছর আমেরিকা-সহ পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে ভারতের দুটি সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন। পুতিন যদিও প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের থেকে জ্বালানি কিনতে পারলে, ভারতের ক্ষেত্রে অসুবিধা কেন হবে? তবুও, নিষেধাজ্ঞার চাপে ভারত রুশ খনিজ তেল আমদানি কিছুটা কমিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ঘাটতি পূরণ করতেই রাশিয়া পাকিস্তানের দিকে নজর ঘোরাতে বাধ্য হয়েছে। তবে, মস্কোর এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে ভারতের জাতীয় স্বার্থের কতটা ক্ষতি করবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এ ধরণের আরও গুরুত্বপূর্ণ আপডেট পেতে ভিজিট করুন www.businesstoday24.com










