কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল শিল্পে পরিবেশগত মানদণ্ড বজায় রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ জাহাজ মালিক কোম্পানি কঠোর আইনি বাধ্যবাধকতা এড়াতে ‘ফ্ল্যাগ অব কনভিয়েন্স’ (Flag of Convenience – FOC) নামক একটি কৌশলী পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের মতে, এটি মূলত জাহাজ মালিকদের দায়বদ্ধতা থেকে বাঁচার একটি ‘আইনি ঢাল’।
‘ফ্ল্যাগ অব কনভিয়েন্স’ কী এবং কেন?
সাধারণত একটি জাহাজ যে দেশে নিবন্ধিত থাকে, সেই দেশের পতাকাই বহন করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাহাজের প্রকৃত মালিকানা ইউরোপের কোনো উন্নত দেশের হলেও সেটি নিবন্ধিত থাকে পানামা, লাইবেরিয়া, বা কমোরোসের মতো উন্নয়নশীল দেশে। একেই বলা হয় ‘ফ্ল্যাগ অব কনভিয়েন্স’।
জাহাজ মালিকরা মূলত দুটি কারণে এই পদ্ধতি বেছে নেন: ১. আইনি বাধ্যবাধকতা এড়ানো: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) শিপ রিসাইক্লিং রেগুলেশন (SRR) অত্যন্ত কঠোর। ইইউ-পতাকাবাহী কোনো জাহাজ ভাঙতে হলে অবশ্যই ইইউ-অনুমোদিত নিরাপদ ইয়ার্ডে পাঠাতে হয়। ২. খরচ কমানো: জাহাজ ভাঙার ঠিক আগে পতাকার নিবন্ধন পরিবর্তন করে এমন দেশের অধীনে নেওয়া হয় যেখানে নিয়মকানুন শিথিল। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অনিরাপদ সৈকতে বা ‘বিচিং’ পদ্ধতিতে কম খরচে জাহাজ ভাঙার সুযোগ পায় মালিকরা, যা ইইউ আইনে নিষিদ্ধ।
সংকটের মূলে আইনি ফাঁকফোকর
বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইন মূলত জাহাজের নিবন্ধিত পতাকার (Flag State) ওপর নির্ভর করে। ফলে জাহাজটি যদি ইউরোপীয় মালিকানাধীন হওয়া সত্ত্বেও অন্য দেশের পতাকায় নিবন্ধিত থাকে, তবে ইইউ তার কঠোর আইন প্রয়োগ করতে পারে না। এই সুযোগ নিয়ে অনেক কোম্পানি পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তার চেয়ে মুনাফাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
উত্তরণের উপায়: সমাধানের ৩টি পথ
বিশেষজ্ঞ এবং এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম এই সংকট নিরসনে তিনটি কার্যকর পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছে:
১. ‘আসল মালিকানা’ অনুযায়ী আইন প্রয়োগ: আইন প্রণেতাদের উচিত জাহাজের নিবন্ধিত পতাকার পরিবর্তে এর প্রকৃত মালিক (Beneficial Owner) কোন দেশের, তার ওপর ভিত্তি করে আইন তৈরি করা। যদি মালিক ইউরোপের কোনো দেশ বা কোম্পানির হয়, তবে জাহাজটি বিশ্বের যেখানেই নিবন্ধিত থাকুক না কেন, তাকে ইইউ-এর পরিবেশগত মানদণ্ড মানতে বাধ্য করতে হবে।
২. আর্থিক গ্যারান্টি বা লিভি প্রবর্তন: প্রতিটি জাহাজ যখন ইইউ-এর বন্দরে আসবে বা চলাচল করবে, তখন তাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ‘রিসাইক্লিং ফান্ড’ হিসেবে জমা নেওয়া যেতে পারে। জাহাজটি যদি শেষ পর্যন্ত নিরাপদ ইয়ার্ডে রিসাইকেল করা হয়, তবেই মালিককে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। এটি মালিকদের দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করবে।
৩. বন্দর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা: ইইউ-এর বন্দরগুলোতে জাহাজগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো। যে সব জাহাজ তাদের আয়ুষ্কাল শেষে অবৈধভাবে পতাকার পরিবর্তন (End-of-life flagging) করে, তাদের ওপর কঠোর জরিমানা এবং ভবিষ্যতে ওই বন্দরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
জাহাজ শিল্পে টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে কেবল পতাকার ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়। প্রকৃত মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাই এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, ‘ফ্ল্যাগ অব কনভিয়েন্স’ নামক এই আইনি চাতুরি বিশ্বজুড়ে সমুদ্র দূষণ এবং শ্রমিকের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়েই চলবে।









