Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্তপাতের রাজনীতি থেকে মানবতার শাসন: অশোকের অবিশ্বাস্য মোড়

রক্তপাতের রাজনীতি থেকে মানবতার শাসন: অশোকের অবিশ্বাস্য মোড়

আমিরুল মোমেনিন

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে খুব কম শাসকই আছেন, যাঁদের জীবন একটি যুদ্ধের পর সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। সম্রাট অশোক তেমনই এক বিরল ব্যতিক্রম। ইতিহাস তাঁকে একদিকে মনে রেখেছে ভয়ংকর বিজেতা হিসেবে, অন্যদিকে মানবিকতা ও শান্তির প্রতীক রূপে। এই দুই বিপরীত সত্তার মাঝখানে রয়েছে এক রক্তাক্ত অধ্যায়, কলিঙ্গ যুদ্ধ।

মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক অশোক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে নির্মম পথ বেছে নেন। প্রতিবেশী রাজ্য দখল, বিদ্রোহ দমন এবং শক্তি প্রদর্শনে তিনি ছিলেন আপসহীন। তাঁর শাসনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ।

বর্তমান ওডিশা অঞ্চলের কলিঙ্গ ছিল স্বাধীনচেতা ও সমৃদ্ধ এক রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ অব্দে অশোক এই রাজ্য দখলে সেনাবাহিনী পাঠান। যুদ্ধটি ছিল দীর্ঘ ও ভয়াবহ। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত হয়, আরও লক্ষাধিক মানুষ বন্দি ও গৃহহীন হয়ে পড়ে। নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে যায়, মাঠভর্তি লাশ আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় জনপদ।

যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়োল্লাসের বদলে অশোক যে দৃশ্য দেখেন, তা তাঁকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। নিহত মানুষের দেহ, কান্নারত নারী ও শিশু, ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি এবং শোকস্তব্ধ পরিবেশ তাঁর বিবেককে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই মুহূর্তেই অশোক উপলব্ধি করেন ক্ষমতা ও জয়ের প্রকৃত মূল্য।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক নিজেই তাঁর শিলালিপিতে যুদ্ধজনিত অনুশোচনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, মানুষের মৃত্যু ও দুর্দশা তাঁকে গভীর দুঃখে আচ্ছন্ন করেছে। এই আত্মোপলব্ধিই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এরপর অশোক গ্রহণ করেন বৌদ্ধ ধর্ম। তিনি সহিংসতা ও আগ্রাসনের পথ ছেড়ে অহিংসা, দয়া ও মানবকল্যাণের নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর শাসনামলে আর কোনো বড় সামরিক অভিযান চালানো হয়নি। বরং তিনি মনোযোগ দেন জনকল্যাণে।

অশোক রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল, সড়ক, পানির কূপ ও বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা করেন। মানুষ ও পশু উভয়ের কল্যাণের কথা তাঁর শাসনে গুরুত্ব পায়। তিনি ধর্মপ্রচারক পাঠান শ্রীলঙ্কা, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য।

আজও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা অশোক স্তম্ভ ও শিলালিপি তাঁর এই রূপান্তরের সাক্ষ্য বহন করে। সিংহচিহ্নিত অশোক স্তম্ভ বর্তমানে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। এটি কেবল একটি সাম্রাজ্যের স্মারক নয়, বরং ক্ষমতার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক দলিল।

নিষ্ঠুর বিজেতা থেকে মানবিক শাসকে রূপান্তরের এই কাহিনি প্রমাণ করে, ইতিহাস শুধু যুদ্ধ ও জয়ের গল্প নয়। কখনো কখনো একটি উপলব্ধিই একজন শাসককে যুগান্তকারী পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে পারে। সম্রাট অশোক তারই উজ্জ্বল উদাহরণ।