বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, কুমিল্লা: কুমিল্লায় প্রথমবারের মতো সফলভাবে সম্পন্ন হলো একটি জটিল অঙ্গ প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার—যা শুধু এই জেলার চিকিৎসা ইতিহাসেই নয়, দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবায়ও এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। জেলার পিপলস হাসপাতালে এক প্রবাসীর হাতের হারানো বৃদ্ধাঙ্গুলের জায়গায় তারই পায়ের আঙুল প্রতিস্থাপন করে এই সাফল্যের নজির স্থাপন করেন চিকিৎসকেরা।
ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মানুষটির নাম আশরাফুল আলম। পেশায় গাড়িচালক, বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি গ্রামে। জীবিকার সন্ধানে ছিলেন সৌদি আরবে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল হারান। সেই থেকেই শুরু হয় এক অসহায় সংগ্রাম—কর্মক্ষমতা হারিয়ে চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়াতে হয় এক হাসপাতাল থেকে অন্যটিতে। কেউ হাত কেটে ফেলার পরামর্শ দেন, কেউ বলেন বিদেশে গিয়ে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে সম্ভবত এই অপারেশন করা যেতে পারে।
অবশেষে কুমিল্লা শহরের পিপলস হাসপাতালে এসে তিনি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। গত শুক্রবার (১ আগস্ট), সাত ঘণ্টা দীর্ঘ এক জটিল অস্ত্রোপচারে ডা. কামরুল ইসলাম মামুনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের চিকিৎসক দল আশরাফুলের বাম পায়ের দ্বিতীয় আঙুলটি কেটে এনে তা বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের স্থানে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। অপারেশনের পরপরই আঙুলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয় এবং ধীরে ধীরে নার্ভ সাড়া দিতে শুরু করে।
ডা. মামুন বলেন, “কুমিল্লায় এটি প্রথমবার শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অঙ্গ প্রতিস্থাপন। এটি নিছক অস্ত্রোপচার নয়, এটি সাধারণ মানুষের জন্য আশার এক নতুন জানালা। রোগীর সঙ্গে আমরা শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, ঝুঁকি রয়েছে এবং সফলতার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশের মতো। কিন্তু আমরা সাহস হারাইনি। রোগী আর চিকিৎসকের সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা সফল হয়েছি।”
এই দলটির সঙ্গে আরও ছিলেন প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মেহেদী হাসান এবং অ্যানেস্থেসিয়ায় বিশেষজ্ঞ ডা. সুমাইয়া তানজিন। পুরো অস্ত্রোপচার চলাকালে অত্যন্ত সতর্কতা ও নির্ভুলতার সঙ্গে প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করা হয়। অস্ত্রোপচারের পরবর্তী সময়ে রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়, যাতে নতুন প্রতিস্থাপিত আঙুল শরীরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ ও কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাউছার হামিদ বলেন, “এ ধরনের অঙ্গ প্রতিস্থাপন দেশের জেলা পর্যায়ে প্রথম বলা যায়। রাজধানী কিংবা বিদেশেই সাধারণত এমন অস্ত্রোপচার হয়। কুমিল্লায় এটা বাস্তবায়ন হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত হলো।”
অপারেশনের পর আশরাফুল বলেন, “যেখানে সবাই বলেছে আমার জীবন থেমে যাবে, সেখানে কুমিল্লার এই হাসপাতাল আমাকে নতুন জীবন দিলো। আমি আবার গাড়ি চালাতে পারবো, আমার পরিবারের রুটিরুজির পথ খুলে গেল।”
এই ঘটনাকে সামনে রেখে কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর মোহাম্মদ বশির আহমদ বলেন, “এটি নিঃসন্দেহে জেলার স্বাস্থ্য খাতের জন্য এক মাইলফলক। এমন জটিল অস্ত্রোপচার এখন আমাদের দেশেই হচ্ছে, জেলা পর্যায়ে। এতে সাধারণ মানুষ দেশেই চিকিৎসা নিতে পারবে, বিদেশ নির্ভরতা কমবে এবং ব্যয়ও অনেকটা হ্রাস পাবে।”
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অপারেশন শুধু একটি চিকিৎসার কাহিনি নয়, এটি একটি বার্তা—সঠিক দক্ষতা, সাহস ও সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাও বিশ্বমানের হতে পারে।