কামরুল ইসলাম, ঢাকা: পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকা মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম এখন আর নিরাপদ থাকছে না। বরং এসব প্রাণিজ আমীষের আড়ালে মানবদেহে প্রবেশ করছে অ্যান্টিবায়োটিক, ভারী ধাতু ও নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ।
খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ চিত্র। খামারিদের অসচেতনতা ও মুনাফালোভী মানসিকতার কারণে জনস্বাস্থ্য এখন চরম হুমকির মুখে।

অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ ও ‘উইথড্রয়াল পিরিয়ড’ লঙ্ঘন
মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের পোল্ট্রি বা হাঁস-মুরগির খামারগুলোতে রোগের প্রকোপ কমাতে এবং দ্রুত বৃদ্ধির জন্য যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রাণীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে তার শরীরে ওষুধের প্রভাব বা অবশিষ্টাংশ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থেকে যায়। একে বলা হয় ‘উইথড্রয়াল পিরিয়ড’ ।
কর্মকর্তারা জানান, মুরগির ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ভেদে এই সময়কাল ৭ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, শেষবার ওষুধ দেওয়ার পর অন্তত এই সময়টুকু অপেক্ষা করতে হয়, যাতে মুরগির শরীর থেকে ওষুধের প্রভাব কেটে যায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অধিকাংশ খামারি এই নিয়ম মানছেন না। ২৮ দিন পার হওয়ার আগেই, ওষুধের প্রভাব থাকা অবস্থায় মুরগি জবাই করে বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে মাংসের সঙ্গে সেই অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করছে।
মাছ ও দুগ্ধজাত পণ্যেও ঝুঁকি
শুধু পোল্ট্রি নয়, একই ঝুঁকি রয়েছে মাছ ও দুগ্ধজাত পণ্যেও। মাছের খামারে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত ফিড বা খাবারে অনেক সময় ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। একইভাবে, গবাদিপশুকে মোটাতাজাকরণ বা রোগমুক্ত রাখতে যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, তার প্রভাব দুধের মাধ্যমে মানুষের শরীরে চলে আসছে। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, খাদ্যের এই চেইনের (Food Chain) মাধ্যমেই নীরবে বিষক্রিয়া ছড়াচ্ছে।
মানবদেহে ভয়াবহ প্রভাব: অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যের মাধ্যমে সুস্থ মানুষের শরীরে নিয়মিত অল্প মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশ করার ফল অত্যন্ত ভয়াবহ।
১. ওষুধের অকার্যকারিতা: অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে মানুষের শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একে বলা হয় ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’।
২. সুপারবাগ: এর ফলে ভবিষ্যতে সাধারণ জ্বর, সর্দি বা কাশির মতো অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। মানুষ ‘সুপারবাগ’-এর ঝুঁকিতে পড়বে, যেখানে সামান্য সংক্রমণও মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
৩. দীর্ঘমেয়াদী রোগ: এছাড়া কিডনি বিকল, লিভারের ক্ষতি এবং শিশুদের হাড় ও দাঁতের গঠন দুর্বল হওয়ার পেছনেও এই দূষিত খাদ্যের ভূমিকা রয়েছে।
নিয়ন্ত্রণের উপায় কী?
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
মনিটরিং বৃদ্ধি: খামার পর্যায়ে নিয়মিত তদারকি করা, যাতে ‘উইথড্রয়াল পিরিয়ড’ না মেনে কোনো পশু-পাখি বাজারজাত করা না হয়।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি বন্ধ: পোল্ট্রি ও মৎস্য খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো এবং ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খামারিদের কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।
সচেতনতা: খামারিদের বোঝাতে হবে যে, তারা নিজেরাও এই বিষাক্ত চক্রের বাইরে নন।
খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, প্রাণিজ আমিষ নিরাপদ করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম এক বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। তাই ‘খামার থেকে খাবার’ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।










