Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য রেঙ্গুনে চট্টগ্রামি সমাজ ও আত্মীয়তার গল্প

রেঙ্গুনে চট্টগ্রামি সমাজ ও আত্মীয়তার গল্প

ট্রেডার্স হোটেল। ছবি সংগৃহীত

ইয়াঙ্গুন সফর: এক সাংবাদিকের চোখে (পর্ব–৩)


কামরুল ইসলাম: ইয়াঙ্গুন সফরের তৃতীয় দিনে আমার সময় কাটল প্রবাসী চট্টগ্রামিদের সঙ্গে। শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো যেন বয়ে এনেছেন কর্ণফুলীর গন্ধ, পাহাড়-সমুদ্রের মায়া, আর পুরনো চট্টগ্রামের কথাবার্তার সুর।

আমার সফরসঙ্গী হেলালউদ্দিন চৌধুরীর আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ব্যবসায়ী, কেউ স্কুলশিক্ষক, কেউ বা সরকারি চাকরিজীবী। বেশিরভাগই দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম, তবু কথায়-আচরণে এখনো চট্টগ্রামের ছাপ অমলিন।

অং সান মার্কেট

এক সন্ধ্যায় আমরা গেলাম চান মিয়াবাদ এলাকায়, যেখানে কয়েকটি চট্টগ্রামি পরিবার একসঙ্গে থাকেন। গলির ভেতর ছোট্ট এক বাড়িতে বসে চায়ের কাপ হাতে গল্পে মেতেছিলেন প্রবীণ ব্যবসায়ী হাজি নুরুদ্দিন আহমদ। বয়স প্রায় আশি, কিন্তু স্মৃতিশক্তি তরুণের মতো টনটনে। বললেন—
“আমার বাবা এসেছিলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে। তখন রেঙ্গুনে কাঠ আর মাছের ব্যবসা হতো খুব। ইংরেজরা যখন এখানে শাসন করত, তখন চট্টগ্রামের লোকজনকে তারা ‘নির্ভরযোগ্য’ মনে করত। তাই অনেকে স্থায়ী হয়ে যান।”

তিনি আরও জানালেন, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর অনেক বাঙালি ফেরত গেলেও কয়েকশ পরিবার থেকে গিয়েছিল ইয়াঙ্গুনে। তাদের মধ্যেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট চট্টগ্রামি পাড়া। মসজিদ, মাদ্রাসা, এমনকি সাংস্কৃতিক ক্লাবও বানানো হয়েছিল নিজেদের উদ্যোগে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাই আজকের  ছুন্নী মসজিদ, যেখানে আমি জুমার নামাজ পড়েছিলাম।

সেদিনের আড্ডায় ছিল পুরনো দিনের গল্প। কে কবে বিয়ে করেছেন স্থানীয় বার্মিজ কন্যাকে, কার ছেলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কে আবার প্রতি ঈদে চট্টগ্রামে টাকা পাঠান। হাসি, গল্প, স্মৃতি সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন ইয়াঙ্গুনে নই, বরং পতেঙ্গা বা আন্দরকিল্লায় কোনো আত্মীয়ের ঘরে বসে আছি।

চট্টল বৌদ্ধ ধর্মদূত বিহার্ ছবি সংগৃহীত

একজন তরুণ বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা চট্টগ্রাম ছেড়ে এলেও মনটা এখনো ওখানেই পড়ে আছে। অনেকে এখনো বলেন, ‘আমাদের দেশ চট্টগ্রাম।’”
তারপর একটু থেমে যোগ করল, “আমরা মিয়ানমারের নাগরিক, কিন্তু রক্তে চট্টগ্রাম।”

এক বিকেলে গেলাম বোটাটাং মার্কেটের পাশে এক ছোট দোকানে। সাইনবোর্ডে লেখা “Chattogram Store – Since 1952”। দোকানদার সালাউদ্দিন আহমেদ জানালেন, তাঁর দাদা খুলেছিলেন এই দোকান, তখন এখানকার বাঙালিরা চট্টগ্রাম থেকে চাল, মসলা, শুঁটকি, বেতের জিনিস এনে বিক্রি করতেন। এখনো কিছু কিছু পণ্য আসে সীমান্তপথে। তিনি গর্বভরে বললেন, “এই দোকানের এক পাশে এখনো ঝুলে আছে আমার দাদার ছবিটা—তিনি পেত্রোবাংলার সাবেক কর্মচারী ছিলেন।”

চট্টগ্রাম-রেঙ্গুন সম্পর্ক শুধু ব্যবসায় বা আত্মীয়তায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি সংস্কৃতি ও জীবনের এক স্থায়ী বিনিময়। এখানকার অনেক বাঙালি পরিবারে এখনো রমজান মানে ‘চট্টগ্রামের ইফতারি’—চনাচুর, চিতই পিঠা, ছোলা ও নোনতা লাচ্ছি। ঈদের সকালে বাজে পুরনো বেতার রেকর্ডে আঞ্চলিক গান—
“ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও রে, কনে খাইব রেঙ্গুনের কামাই রে…”

এই গান যেন আজও তাদের আত্মপরিচয়ের অংশ।
বয়োজ্যেষ্ঠ এক ভদ্রলোক বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন চট্টগ্রাম থেকে এখানে এসেছিলেন, তাঁরা সঙ্গে এনেছিলেন শুধু ব্যবসা নয়, নিয়ে এসেছিলেন মন ও মাটি। সেটাই এখনো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।”

সেদিন রাতের শেষে হোটেল ট্রেডার্সের জানালা দিয়ে ইয়াঙ্গুন শহরটা তাকিয়ে দেখছিলাম। উঁচু ভবনের আলোয় ঝলমল শহর, তবু কোথাও এক অদৃশ্য টান টের পাচ্ছিলাম চট্টগ্রাম থেকে ভেসে আসা সম্পর্কের সুর। মনে হলো, সীমানা পেরিয়ে সময় হয়তো মুছে দেয় মানচিত্র, কিন্তু মুছে দিতে পারে না মানুষের শিকড়।