ভ্রমণ কাহিনী: দেশ থেকে দেশে
সাইয়েদ আহমেদ
ইস্তাম্বুল শহরটা যেন ইতিহাস আর জীবনের মধ্যকার এক সেতুবন্ধন। ইউরোপ আর এশিয়ার সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা এই নগরীতে পা রেখেই যেন অনুভব করা যায় প্রাচীন কালের কোনো এক অদ্ভুত আহ্বান। আধুনিকতার চকচকে পর্দার আড়ালে এ শহর লুকিয়ে রেখেছে বিস্ময়, বিষণ্ণতা আর ভীষণ রকমের মানবিকতা।
সেই দিন দুপুরবেলা হোটেল থেকে বের হলাম একা। হালকা মেঘলা আকাশ, মাঝেমধ্যেই বাতাসে ভেসে আসছিল সামান্য ঠান্ডা। হেঁটে চললাম সুলতান আহমেদের মসজিদের দিকে। মসজিদ চত্বর পার হতেই এক সরু গলিতে প্রবেশ করলাম। ইট বসানো পথের দুপাশে ছোট ছোট দোকান, কাঠের তৈরি জানালা আর প্রতিটি দেয়ালে ইতিহাসের ছাপ। হঠাৎই আকাশটা কালচে হয়ে উঠল। তারপর সেই বৃষ্টি। এমন এক নরম আর গভীর বৃষ্টি, যেন শহরের পুরোনো স্মৃতিগুলো জেগে উঠল একসাথে।
গলিপথের কোণে একটি ছোট চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম কিছু মানুষ। বৃষ্টি একটু জোরে পড়লে চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। দোকানির হাসিমুখ আর ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে আমি অনুভব করলাম যে শহরগুলোও অনুভব করতে জানে।
সেই সময় পাশে এসে বসেন একজন তুর্কি বৃদ্ধ। তাঁর চোখে ছিল দীর্ঘ পথচলার চিহ্ন, মুখে নির্ভেজাল সৌজন্য। পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। শুনেই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, বাংলাদেশ আমাদের ভাইয়ের মতো। এই অচেনা শহরে এমন আন্তরিক স্বীকৃতি যেন অন্তরটা ভরে দিল।
তিনি তুর্কি ভাষায় বলছিলেন, আমি ইংরেজি কিংবা ভাঙা তুর্কিতে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কথা নয়, আমাদের মাঝে চলছিল আরেক ভাষা—চোখের ভাষা। কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে, যেগুলো ভাষার চেয়ে অনেক গভীর।
বৃষ্টি থেমে গেলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। গলিপথে দেখা মিলল মোজাইক কারিগরদের। হাতে গড়া আলোর প্রদীপগুলো এমনভাবে সাজানো যে মনে হয়, ওগুলো শুধু আলো দেয় না, আত্মার একটা অংশ ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। একটিকে হাতে নিয়ে দেখলাম, কিনিনি, কিন্তু সেই নরম রঙিন আলোয় নিজের মুখ যেন নতুন করে চিনলাম।
চলতে চলতে চলে এলাম বসফরাস সেতুর দৃষ্টিসীমায়। এক পাশে ইউরোপ, অন্য পাশে এশিয়া। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি মাঝামাঝি, ঠিক যেমন নিজের জীবনের মাঝপথে এসে দাঁড়ায় মানুষ। মনে হল, এই শহর শুধু ইতিহাস নয়, আত্মদর্শনের এক দরজা খুলে দেয়।
ইস্তাম্বুল আমার কাছে হয়ে উঠল এক নিজস্ব অনুভবের শহর। সেখানে আমি হারিয়েছিলাম নিজেকে, আবার ফিরে পেয়েছিলাম এক নতুন আমি।
আপনিও যদি এমন এক যাত্রায় বের হতে চান, যেখানে প্রতিটি পথ যেন গল্প বলে, প্রতিটি মানুষ যেন আপনজন হয়ে ওঠে, তবে একবার ঘুরে আসুন ইস্তাম্বুল। সে আপনাকে শুধু শহর দেখাবে না, আপনাকে নিজেকেও চিনিয়ে দেবে।
এই লেখাটি যদি আপনার মন ছুঁয়ে যায়, তবে লাইক দিন, শেয়ার করুন প্রিয়জনের সঙ্গে।
কমেন্টে জানান আপনিও কখনো এমন কোনো অনুভবের শহরে হারিয়ে গিয়েছিলেন কি না।