লুবনা তাসনিম
প্রযুক্তির উৎকর্ষে আজ ঘরে বসেই গুগল ম্যাপসে পুরো পৃথিবী দেখা যায়। কিন্তু আপনি যদি বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মানচিত্রে চোখ রাখেন, তবে উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি অদ্ভুত দৃশ্য আপনার নজর কাড়বে। নীল জলরাশির বুকে জেগে থাকা এক বিশাল লোহার কঙ্কাল—’এমভি প্রিমরোজ’। দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে সমুদ্রের নোনা জল আর ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে এই জাহাজটি। এটি কেবল একটি সাধারণ জাহাজডুবির গল্প নয়; এটি সেই বিরল মুহূর্তের সাক্ষী, যখন আধুনিক সভ্যতার সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন ও রহস্যময় আদিবাসী গোষ্ঠী ‘সেন্টিনেলিজ’দের এক অপ্রত্যাশিত সংঘাত ঘটেছিল।
ঝড়ের কবলে ও ভুল গন্তব্য
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮১ সালের ২ আগস্ট। হংকং-ভিত্তিক ১৬,০০০ টনের বিশাল মালবাহী জাহাজ ‘এমভি প্রিমরোজ’ বাংলাদেশ থেকে মুরগির খাবার (চিকেন ফিড) নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু সমুদ্রের মতিগতি বোঝা ভার। মাঝপথে প্রবল সামুদ্রিক ঝড় আর ঘন কুয়াশার চাদরে পথ হারায় জাহাজটি। উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে জাহাজটি গিয়ে আছড়ে পড়ে উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে একটি প্রবালপ্রাচীরে। ক্যাপ্টেন লিউ চুংলং এবং তাঁর ৩০ জন নাবিক তখনো জানতেন না, প্রকৃতির চেয়েও ভয়ংকর এক বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছেন তাঁরা।
তীর-ধনুক বনাম আধুনিক মানুষ
জাহাজটি চড়ায় আটকে পড়ার পর প্রথম কয়েক দিন নাবিকরা রেডিওর মাধ্যমে ‘ডিস্ট্রেস সিগন্যাল’ বা বিপদবার্তা পাঠাতে থাকেন। কিন্তু শীঘ্রই তাঁরা লক্ষ্য করেন, দ্বীপের জঙ্গল থেকে একদল মানুষ বেরিয়ে আসছে। কোনো উদ্ধারকারী দল নয়, বরং প্রায় ৫০ জন উলঙ্গ, কৃষ্ণকায় মানুষ হাতে তীর-ধনুক ও বল্লম নিয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে জাহাজের দিকে এগোতে চেষ্টা করছে।
মুহূর্তেই জাহাজের পরিবেশ ভীতিপ্রদ হয়ে ওঠে। সেন্টিনেলিজরা তাদের দ্বীপ রক্ষায় সর্বদা আপোষহীন। ক্রু মেম্বাররা বুঝতে পারেন, তাঁরা এমন এক দ্বীপে এসে পড়েছেন যেখানে বাইরের মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং যার শাস্তি মৃত্যু। নাবিকরা আত্মরক্ষার জন্য জাহাজের মজুত করা কুড়াল, লোহার পাইপ এবং ফ্লেয়ার গান (সংকেত দেওয়ার বন্দুক) হাতে তুলে নেন। সৌভাগ্যক্রমে, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ সেন্টিনেলিজদের ছোট নৌকাগুলোকে জাহাজের কাছে ভিড়তে দেয়নি। এই ২৪ ঘণ্টা ছিল নাবিকদের জীবনের দীর্ঘতম ও আতঙ্কের সময়।
উদ্ধার অভিযান ও পরিত্যক্ত জাহাজ
অবশেষে প্রায় এক সপ্তাহ পর, ভারতীয় নৌবাহিনী এবং ‘অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন’ (ONGC)-এর হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। প্রবল বাতাসের মধ্যে হেলিকপ্টার নামিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের উদ্ধার করা হয়। মানুষের প্রাণ বাঁচলেও, জাহাজটি সেই প্রবালপ্রাচীরেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে।
পরবর্তীতে এম. এ. মোহাম্মদ নামের এক স্ক্র্যাপ ডিলার জাহাজটি ভাঙার দায়িত্ব পান। প্রায় ১৮ মাস ধরে চলা এই প্রক্রিয়ায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। শ্রমিকরা যখন কাজ করত, সেন্টিনেলিজরা দূর থেকে তা পর্যবেক্ষণ করত। এমনকি শোনা যায়, শ্রমিকরা পানিতে কলা বা নারকেল ভাসিয়ে দিলে বিনিময়ে আদিবাসীরা ধাতুর টুকরো নিয়ে যেত। তবে পুরোপুরি বন্ধুত্ব কখনোই গড়ে ওঠেনি।
সেন্টিনেলিজদের ‘লৌহ যুগ’ ও বর্তমান দৃশ্য
এমভি প্রিমরোজের এই ধ্বংসাবশেষ সেন্টিনেলিজদের জীবনযাত্রায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রস্তর যুগের এই মানুষগুলো জাহাজের শরীর থেকে লোহা সংগ্রহ করে তাদের তীরের ফলা ও অস্ত্রের ধারালো অংশ তৈরি করতে শেখে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে, এই জাহাজটিই তাদের এক লাফে ‘লৌহ যুগে’ প্রবেশ করিয়েছে।
আজ ২০২৫ সালে এসেও গুগল আর্থ বা স্যাটেলাইট ইমেজে এমভি প্রিমরোজের ধ্বংসাবশেষ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। অক্টোবর ২০২৫-এর স্যাটেলাইট আপডেটে দেখা গেছে, দ্বীপবাসীরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষের কাছাকাছি নতুন পায়ে চলা পথ তৈরি করেছে। হয়তো লোহা সংগ্রহ কিংবা নজরদারির জন্য তারা আজও এই ‘লোহার দৈত্য’র কাছে নিয়মিত যাতায়াত করে।
উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের নির্জন তটে মরচে পড়া এমভি প্রিমরোজ আজ কেবল একটি জড়বস্তু নয়; এটি আধুনিক বিশ্ব এবং এক আদিম সভ্যতার অসমাপ্ত সংযোগের এক নীরব স্মৃতিস্তম্ভ।









