ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ২:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের মানচিত্র খুললেই চোখে পড়ে নদীর বেষ্টনী। এই জেলার বুক চিরে বয়ে গেছে তিনটি বড় নদী ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলা। এ নদীগুলো শুধু জলধারা নয়, বরং এ জনপদের আনন্দ ও আতঙ্কের নাম। বছরের একটি অংশে এরা দেয় সেচ, মাছ আর জীবন, আর বাকি সময়ে বয়ে আনে ভাঙন, বন্যা ও মৃত্যু।
ধরলার ভাঙনে ছিন্নমূল
ধরলা নদীর উৎপত্তি ভারতের হিমালয় অঞ্চল থেকে। এটি কুড়িগ্রামের সীমানায় প্রবেশ করে প্রবল বেগে ছুটে চলে, কখনও বাঁধ কেটে, কখনও ঘর ভেঙে। প্রতি বছর ধরলার ভাঙনে কুড়িগ্রামের কয়েকটি ইউনিয়ন মানচিত্র থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসে।
বিশেষ করে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর ও নাগেশ্বরী উপজেলার চর ও নদীতীরবর্তী গ্রামগুলো ভাঙনের শিকার হয় বেশি। অনেকে বছরে দু-তিনবার ঘর পাল্টায়—কখনো আত্মীয়ের উঠোনে, কখনো রাস্তার পাশে।
স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, “আমার বিয়ের পর পাঁচবার ঘর ভাঙছে ধরলায়। এখন তো আর গুনতেও পারি না কত বিঘা জমি গেছে।”
ব্রহ্মপুত্রের রূপ: বিশালতা ও বিভীষিকা
ব্রহ্মপুত্র নদ যতখানি ঐতিহাসিক, ততটাই ভয়ংকর। এর উপনদী দুধকুমারও প্রবল বন্যা নিয়ে হাজির হয় বর্ষাকালে।
চিলমারী, রৌমারী, রাজীবপুর—এই তিন উপজেলায় ব্রহ্মপুত্রের তাণ্ডব নিয়মিত চিত্র। বাঁধ নির্মাণ, ড্রেজিং কিংবা নদীশাসন—কোনটিই টেকেনি দীর্ঘস্থায়ীভাবে। নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চর, সেগুলোতে গড়ে ওঠা বস্তি, আবার বর্ষায় সব ভেসে যাওয়া—এই চক্রে অভ্যস্ত মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রহ্মপুত্রের মোহনামুখী শাখাগুলো বর্ষায় দিক পাল্টায় এবং অনিয়ন্ত্রিত স্রোতের কারণে নদীর গতিপথ অনিশ্চিত হয়। তাই নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা এখানে আরও কঠিন।
তিস্তা – প্রতিশ্রুতির নদী, কিন্তু…
তিস্তা নদী একসময় ছিল কুড়িগ্রামের প্রাণ। এখন সেটাই হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার উৎস। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা হয়ে পড়ে রুক্ষ ও নালানালা, আর বর্ষাকালে হঠাৎ জল ঢুকে ভয়াবহ বন্যা ডেকে আনে।
ভারতের গজলডোবার ব্যারাজ থেকে নিয়ন্ত্রিত পানির প্রবাহ কুড়িগ্রামে পৌঁছায় না ঠিকমতো। ফলে নদীর প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছে। তিস্তার তীরে কৃষিকাজ এখন অনিশ্চিত। বর্ষায় সেচ দিতে হয় না, কিন্তু শীতকালে সেচহীন জমিতে ফলন কমে যায়।
স্থানীয় চাষি সোহেল মিয়া বললেন, “তিস্তায় এখন আর পানি থাকে না। একটা সময় ছিল, যেখানে মাছ ধরা আর চাষ—দুই-ই হতো। এখন কিছুই নেই।”
বন্যা, ক্ষয়ক্ষতি ও রাষ্ট্রের দায়
কুড়িগ্রামে বছরে গড়ে দুই থেকে তিনবার বন্যা হয়। কখনো অগ্রিম সতর্কতা ছাড়া হঠাৎ পানি বেড়ে যায়। এতে তলিয়ে যায় বাড়ি-ঘর, ফসল, স্কুল ও ক্লিনিক।
২০২০ সালের বন্যায় জেলার ৯টি উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্য সংকট, পানিবাহিত রোগ, আশ্রয়হীনতা—এই সবই মিলে তৈরি হয় এক মানবিক সংকট।
সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কিছু সাময়িক ত্রাণ দিলেও স্থায়ী নদীশাসন, চরবাসীদের পুনর্বাসন বা জীবিকা নিশ্চিত করার মতো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
নদীকে বোঝা নয়, সঙ্গী হিসেবে ভাবা জরুরি
কুড়িগ্রামের নদীগুলোকে যদি কেবল ভয় বা বাধা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। এদের ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে চরকেন্দ্রিক কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, নৌ-পর্যটন, মাছ চাষ ও নদী-বাণিজ্য। প্রয়োজন নদীকে নিয়ন্ত্রণ নয়, সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
(পরবর্তী পর্ব: চরাঞ্চলের জীবন – শূন্য থেকে শুরু করা মানুষের গল্প)
📣 আপনার মতামত দিন
এই প্রতিবেদনটি যদি আপনাকে স্পর্শ করে, তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন। নদী ও মানুষের এই লড়াইয়ের গল্প আরও অনেকের জানা জরুরি।
💬 নিচে কমেন্ট করে জানিয়ে দিন—আপনার চোখে কেমন কুড়িগ্রামের নদীভাঙনের বাস্তবতা?
📲 বিজনেসটুডে২৪.কম – আপনার খবর, আপনার কণ্ঠস্বর।