Home Second Lead এনার্জি ট্রানজিশন: ঝুঁকির মুখেও কেন কয়লা ছাড়ছে বিশ্ব?

এনার্জি ট্রানজিশন: ঝুঁকির মুখেও কেন কয়লা ছাড়ছে বিশ্ব?

তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিশ্ব এক ঐতিহাসিক জ্বালানি বিবর্তনের সাক্ষী হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন—এই দুইয়ের চাপে পড়ে কয়েক শতাব্দী ধরে জ্বালানি সাম্রাজ্য শাসন করা ‘কয়লা’ এখন তার আধিপত্য হারাচ্ছে। তবে এই রূপান্তর যতটা জরুরি, এর পথ ততটাই চ্যালেঞ্জিং। একদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির জয়গান, অন্যদিকে জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি—এই দুইয়ের দোলাচলে দুলছে বর্তমান বিশ্ব।

 আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA) এর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, উন্নত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে পুরোপুরি সরে আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কয়লা প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে সৌর ও বায়ু শক্তির মতো সবুজ শক্তিতে বিনিয়োগ করছে। গত ১০ বছরে সৌর বিদ্যুতের খরচ প্রায় ৮৫% কমেছে, যা কয়লার তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক এবং সাশ্রয়ী।

 নবায়নযোগ্য শক্তি এখন আর কেবল তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, বরং বাস্তবসম্মত বিকল্প। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দৌড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিশাল মরুভূমি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের বাড়ির ছাদ—সবখানেই এখন সোলার প্যানেলের আধিপত্য। পাশাপাশি সমুদ্রের তলদেশে বিশাল উইন্ড টারবাইন বসিয়ে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ভারী শিল্পে কয়লার বিকল্প হিসেবে ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’ নিয়ে আসা হচ্ছে, যা কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে সহায়ক হবে।

কয়লা থেকে দ্রুত সরে আসার পথে কিছু বড় ঝুঁকিও বিদ্যমান। প্রথমত, ‘গ্রিড স্ট্যাবিলিটি’ বা স্থিতিশীলতা। সূর্য না থাকলে বা বাতাস না বইলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখা কঠিন, আর বিশাল চাহিদার তুলনায় ব্যাটারি স্টোরেজ প্রযুক্তি এখনো বেশ ব্যয়বহুল। দ্বিতীয়ত, খনিজ সম্পদের ভূ-রাজনীতি। সৌর প্যানেল বা ইভি ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম ও কোবাল্টের সরবরাহ শৃঙ্খল মূলত গুটিকয়েক দেশের নিয়ন্ত্রণে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। এছাড়া, কয়লা শিল্পের সাথে যুক্ত কোটি কোটি শ্রমিকের কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টি একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি।

ভারত, বাংলাদেশ বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জটা ভিন্ন। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সস্তা জ্বালানি হিসেবে তারা এখনো কয়লার ওপর নির্ভরশীল। তবে ‘জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপ’ (JETP) এর মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো এসব দেশকে সবুজ শক্তিতে রূপান্তরে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে ‘নেট জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে কয়লা ত্যাগের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব এখন এক বিশাল জ্বালানি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকি থাকলেও নবায়নযোগ্য শক্তির উত্থান অনিবার্য। ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ থেকে মুক্ত হয়ে একটি সবুজ ও টেকসই পৃথিবী গড়ার লড়াইয়ে মানবজাতি এখন অনেক বেশি প্রত্যয়ী।