Home জাহাজ ভাঙা শিল্প জাহাজ ভাঙার নামে পরিবেশ হত্যার ছক? জার্মান আদালতের রায় ঘিরে প্রশ্ন

জাহাজ ভাঙার নামে পরিবেশ হত্যার ছক? জার্মান আদালতের রায় ঘিরে প্রশ্ন

ওয়েস্টারহ্যামম

কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম : পরিবেশবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে বহুল আলোচিত ওয়েস্টারহ্যামম জাহাজ স্ক্র্যাপিং মামলা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অভিযুক্তদের খালাস দেওয়া আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে জার্মানির সরকারি কৌঁসুলি আপিল করেছেন। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে পরিবেশ অধিকারভিত্তিক সংগঠন এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফরম।

আসামিরা খালাস পেলেও বিচারক মার্টিয়ে হেইনসনের কণ্ঠে স্পষ্ট অনুশোচনার সুর। বলেন, “আপনারা যা করেছেন, তা ঠিক নয়। মুনাফার আশায় পরিবেশের বড় ক্ষতি করেছেন। এখন অন্তত কিছু ফেরত দিন পরিবেশকে।”

মামলার কেন্দ্রে ১৮৮ মিটার দীর্ঘ কন্টেইনার জাহাজ ওয়েস্টারহ্যামম এমএসসি পরিচালিত এ জাহাজটি ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রেমারহ্যাভেন থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতের  গুজরাটের আলাং সৈকতে গিয়ে স্ক্র্যাপ হয়।   তখনও জাহাজটি সচল ছিল, তবুও মালিকপক্ষের পরিত্যাগের ইচ্ছা ছিল পুরোমাত্রায় স্পষ্ট। তাই এটি ইউরোপীয় বর্জ্য আইন অনুযায়ী ‘ওয়েস্ট’ হিসেবেই গণ্য।

আদালত বলেছে, পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত জাহাজ আন্তর্জাতিক জলসীমায় পৌঁছার পর নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনজিও প্ল্যাটফর্ম বলছে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জার্মানির অফিসে। কাজেই রপ্তানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে দায়ও জার্মানির।

এমন অবৈধ চর্চা আগেও ঘটেছে। নরওয়েতে ALTERA, পাকিস্তানে Harrier, বাংলাদেশে নর্থ সী প্রডিউসার সব কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে একই কৌশল: মেরামতের নামে মিথ্যা, শেষমেশ স্ক্র্যাপিং।

এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফরম-এর নির্বাহী পরিচালক ইংভিল্ড জেনসেন বলেন, “শিপিং ইন্ডাস্ট্রি এখন জানে কীভাবে আইন ফাঁকি দিতে হয়। ওয়েস্টারহ্যামম-এর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল জার্মানিতেই। জাহাজ কোথায় ছিল, সেটিই মূল নয়।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলাটি ইউরোপীয় পরিবেশ নীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। যদি মালিকদের দায়মুক্তি চলতেই থাকে, তবে সাগরজুড়ে পরিবেশ বিপর্যয় শুধু সময়ের অপেক্ষা।

এম ভি নর্থ সী প্রোডিউসার (MV North Sea Producer) জাহাজটি সীতাকুণ্ডে স্ক্র্যাপ করার ঘটনা বাংলাদেশের পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষা বিষয়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই জাহাজটি একটি ফ্লোটিং প্রোডাকশন স্টোরেজ অ্যান্ড অফলোডিং (FPSO) ইউনিট হিসেবে ১৭ বছর ধরে উত্তর সাগরে তেল ও গ্যাস উত্তোলনে ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৬ সালে এটি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং সীতাকুণ্ডের জনতা স্টিল কর্পোরেশনের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে ভেড়ানো হয়।

MV North Sea Producer

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী, জাহাজটি আমদানির সময় “হ্যাজার্ডাস ম্যাটেরিয়াল ফ্রি” হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় এতে বিপজ্জনক মাত্রার রেডিওঅ্যাকটিভ বর্জ্য এবং ৫০০ কেজি অ্যাসবেস্টস রয়েছে।

এই ঘটনায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি  জনস্বার্থে মামলা দায়ের করে। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ জাহাজটির আমদানি, উপকূলে ভেড়ানো এবং ভাঙার কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে। আদালত নির্দেশ দেয় যে, জনতা স্টিল কর্পোরেশনকে এই প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখা হবে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে বলা হয়।

এই ঘটনা বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পে বিদ্যমান অনিয়ম, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং শ্রমিক সুরক্ষা ঘাটতির একটি উদাহরণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে এবং কঠোর পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে এই শিল্পকে টেকসই ও নিরাপদ করা সম্ভব।

পরিবেশবিদরা জাহাজভাঙা শিল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের ওপর জোর দিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই শিল্পে পরিবেশ ও শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা না হলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর পরিবেশগত ও মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে।