বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক:
দক্ষিণ এশিয়ার চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধাবস্থায় রূপ নেয়, তাহলে তার প্রভাব শুধু ওই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না তা পৌঁছাতে পারে হাজার কিলোমিটার দূরের মালয়েশিয়াতেও। বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সংঘাতের ফলে মালয়েশিয়ার খাদ্যপণ্য, শিল্প কাঁচামাল এবং সাধারণ আমদানি পণ্যের জোগান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান—দুটি দেশ থেকেই মালয়েশিয়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চাল, মসলা, পেঁয়াজ, ডাল, চিনি, গবাদিপশুর মাংস, কাপড়, রেডিমেড পোশাক, ফলমূল, বিফ, ওষুধ এবং বিভিন্ন ধাতব কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। কুয়ালালামপুর ও সেলাঙ্গর ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি নিবাস রঘবনের মতে, “যদি উত্তেজনা যুদ্ধের দিকে যায়, তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যকার নৌ-পরিবহনে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এতে খাদ্য ও মৌলিক পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “চাল, পেঁয়াজ, ডাল, মসলা এসব অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম ও সরবরাহ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। অন্য দেশ থেকে এসব আনা সম্ভব হলেও সেগুলোর গুণগত মান ও সরবরাহের পরিমাণ আমাদের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নাও হতে পারে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার ভোক্তাবাজারে ভারতীয় ও পাকিস্তানি পণ্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে মালয়েশিয়ার চালের ৪০ শতাংশ আমদানি হয় ভারত থেকে, এবং পাকিস্তান সরবরাহ করে উন্নতমানের বাসমতি চাল। এছাড়া, উত্তর ভারত থেকেই আসে ৮০-৯০ শতাংশ রেডিমেড পোশাক ও ৫০ শতাংশ শাড়ি। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যের দামে আগুন লেগে যেতে পারে।
মালয়েশিয়ান ইন্ডিয়ান টেক্সটাইলস অ্যান্ড জেনারেল স্টোর অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব দাতিন মাহেশ্বরী রামাসামি জানান, “উত্তর ভারত থেকে যদি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মসলা, শাড়ি, পুজার সামগ্রী, বাসন-কোসন সবকিছুর জোগান কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে খুচরা বাজারে।” পাকিস্তান থেকে আসা কার্পেট ও কাপড়ের ব্যবসার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যবসায়ী আশাবাদী হলেও, তারা কৌশলী মনোভাব গ্রহণ করছেন। যেমন, মাইদিন হাইপারমার্কেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাতুক আমির আলি মাইদিন বলেন, “এখন পর্যন্ত সরবরাহে বড় কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। তবে বাজারে গুজব ছড়িয়ে দাম বেড়ে যেতে পারে।”
ব্যাংক মুআমালাত মালয়েশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোহদ আফজানিজাম আবদুল রশিদ এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে পরিবহন খরচ বাড়বে, বিশেষ করে বিমানপথে রুট পরিবর্তনের কারণে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়াতে ‘নিরাপদ সম্পদ’ হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছে। যদিও ভারত ও পাকিস্তানে মালয়েশিয়ার মোট রপ্তানির মাত্র ৩.৪% এবং ০.৪% যথাক্রমে, তবে আমদানিনির্ভর ভোক্তাবাজারে এর প্রভাব স্পষ্ট হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ কেবল সীমান্তের বিষয় নয়; এটি অর্থনৈতিক সরবরাহ চেইনকে ভেঙে দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ যদি সংঘাতে জড়ায়, তাহলে শুধু মালয়েশিয়া নয়, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি সংকটে পড়তে পারে।
ব্যবসায়ীরা একমত যে, এখনই বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার সময় এসেছে। আবার কেউ কেউ সরকারের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন, যাতে সংকটকালীন পর্যাপ্ত মজুত ও দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।
অবশ্যই, যুদ্ধ না হলে তা সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু সেই আশার পাশাপাশি প্রস্তুতিও জরুরি। কারণ আজকের ভূরাজনীতি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে দিতে পারে বহুকাল ধরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ভারসাম্য।