৮৫% ফলই পাকানো হচ্ছে কার্বাইড ও ফরমালিনে
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাহ্যিক চাকচিক্য আর টসটসে রঙ দেখে যে ফলটি আপনি পরম যতে্নে পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে শিশুদের মুখে তুলে দিচ্ছেন—তা আসলে কতটা নিরাপদ?
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম করার মতো।
গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া ফলের প্রায় ৮৫ শতাংশই প্রাকৃতিকভাবে পাকা নয়; বরং ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন এবং ফরমালিনের মতো মারাত্মক রাসায়নিক প্রয়োগ করে এগুলো পাকানো ও সংরক্ষণ করা হয়।
অনুসন্ধানে উঠে আসা ভয়াবহ চিত্র
রাজধানীর বাদামতলী, কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ীর ফলের আড়তগুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এক ভিন্ন জগত। অপরিপক্ক বা কাঁচা ফল গাছ থেকে পেড়ে আড়তে আনা হয়। এরপর রাতের আঁধারে কিংবা প্রকাশ্যে স্প্রে মেশিন দিয়ে ছিটানো হয় কেমিক্যাল।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মূলত তিনটি ধাপে এই ‘বিষ’ প্রয়োগ করা হয়:
১. গাছে থাকা অবস্থায়: ফল দ্রুত বড় করতে হরমোন স্প্রে।
২. পাকানোর সময়: আড়তে আনার পর কাঁচা ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ইথোফেন প্রয়োগ। এতে মাত্র ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাঁচা ফল হলুদ বা লালচে রঙ ধারণ করে।
৩. সংরক্ষণ: পচন রোধে ফরমালিন বা ছত্রাকনাশক রাসায়নিকের ব্যবহার।
বাদামতলীর এক ফল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “গাছপাকা ফল ঢাকায় আনতে আনতে পচে যায়। তাই কাঁচা মাল এনে ‘ওষুধ’ (কেমিক্যাল) দিয়ে পাকাই। এতে রং সুন্দর হয়, কাস্টমারও খুশি থাকে। সবাই দেয়, আমি না দিলে ব্যবসা করব কীভাবে?”
গবেষণার তথ্য: ৮৫ শতাংশই ভেজাল
ক্যাব ও বিএসটিআই-এর যৌথ গবেষণায় ফলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আম, কলা, পেঁপে, আনারস এবং পেয়ারাতেই সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ফলে যে মাত্রায় কার্বাইড ও ইথোফেনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তা মানবদেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ক্যালসিয়াম কার্বাইড বাতাসের জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরি করে, যা ফলকে উত্তপ্ত করে দ্রুত পাকিয়ে ফেলে। এই কার্বাইডে আর্সেনিক ও ফসফরাসের মতো বিষাক্ত উপাদানও থাকে।
জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: নীরব ঘাতক
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এই কেমিক্যালযুক্ত ফল খাওয়া আর ধীরলয়ে বিষপান করা একই কথা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক বিশেষজ্ঞ জানান, “কার্বাইড ও ফরমালিনযুক্ত ফল খাওয়ার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে পেটে পীড়া, ডায়রিয়া বা বমি হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি লিভার সিরোসিস, কিডনি অকেজো হওয়া এবং পাকস্থলী ও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এই বিষাক্ত ফল।”
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ অনুযায়ী, খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাঝেমধ্যে র্যাব বা বিএসটিআই-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করে এবং মণকে মণ আম বা ফল ধ্বংস করে। কিন্তু অভিযানের তোড়জোড় কমলেই আবার পুরনো চিত্রে ফিরে আসেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
ক্যাবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “শুধু রমজান মাসে বা ফলের মৌসুমে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। রাসায়নিকের আমদানির উৎস এবং খোলা বাজারে এর সহজলভ্যতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৮৫ শতাংশ ফল দূষিত হওয়া মানে পুরো জাতি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।”
পুষ্টির আশায় ফল খেয়ে মানুষ যদি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি কিনে বাড়ি ফেরে, তবে তা চরম উদ্বেগের। ফলের বাজারকে বিষমুক্ত করতে হলে কেবল জরিমানা নয়, নিয়মিত মনিটরিং, রাসায়নিকের উৎস বন্ধ করা এবং ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। অন্যথায়, ‘পুষ্টিকর ফল’ শব্দটি কেবল বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।









