ফিচার
শাহেদা পারভিন
চট্টগ্রামের খাবারের তালিকায় বিফ কালাভুনা এক অনন্য নাম। নাম শুনলেই বোঝা যায় এটি শুধু একটি রান্না নয়, বরং চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, আতিথেয়তা ও ঐতিহ্যের অংশ। অনেকেই মনে করেন মাংস ভাজতে ভাজতে কালো হয়ে গেলে সেটিই কালাভুনা। আসলে এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। প্রকৃত কালাভুনার রহস্য লুকিয়ে আছে বিশেষ মশলার ব্যবহার, ধৈর্যশীল রান্না এবং অনন্য কৌশলে।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, চট্টগ্রামের এই পদটির সূচনা হয় উনিশ শতকের শেষ দিকে। তখন বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামে আরব, পারসিক ও স্থানীয় বাঙালির মিলনমেলা ছিল। মসলার ব্যবসার কারণে চট্টগ্রামে নানা ধরনের বিশেষ মশলা সহজলভ্য ছিল। স্থানীয় রান্নাঘরে এ মশলার মিশ্রণে জন্ম নেয় বিফ কালাভুনা। মুসলিম সামাজিক আড্ডা, ঈদ, বিবাহ অনুষ্ঠান কিংবা বড় ধরনের দাওয়াতে এই খাবার ধীরে ধীরে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে কালাভুনার ভিন্ন ভিন্ন ধারা আছে। তবে মূলত গরুর মাংস ধীরে ধীরে মশলার সঙ্গে কষানোই এর প্রাণ। পেঁয়াজ বাটা, আদা, রসুন, ধনে, জিরে, দারুচিনি, এলাচ থেকে শুরু করে কালোজিরে ও জয়ত্রীর বিশেষ মিশ্রণ মাংসকে দেয় গভীর স্বাদ। রান্নার সময় অতিরিক্ত জল ব্যবহার করা হয় না। মাংস নিজের জলেই কষতে থাকে, আর এভাবেই মাংসে জমা হয় মসলার ঘ্রাণ ও রঙের গভীরতা। রান্না শেষে যখন তেল আলাদা হয়ে উপরে ভেসে ওঠে, তখনই বোঝা যায় কালাভুনা তৈরি হয়ে গেছে।
প্রথম দিকে এই পদ সাধারণত ঈদুল আজহার কোরবানির মাংস দিয়েই তৈরি হতো। কারণ তখন প্রচুর মাংস ঘরে আসত এবং দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল না। তাই মাংস দ্রুত ব্যবহার করে সুস্বাদু খাবার বানানোর এক কৌশল হিসেবেই কালাভুনা জনপ্রিয় হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি উৎসব ছাড়াও পরিবারের নিয়মিত বিশেষ খাবারে পরিণত হয়েছে।
আজকাল রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে ঢাকার অভিজাত হোটেল, এমনকি বিদেশে প্রবাসী চট্টগ্রামবাসীর রান্নাঘরেও কালাভুনার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ খাবার শুধু চট্টগ্রামের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং বাংলাদেশি খাদ্যসংস্কৃতির একটি বিশেষ পরিচয় হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের কালাভুনা সাধারণ ভাত, খিচুড়ি, রুটি বা পরোটার সঙ্গে খাওয়া যায়। তবে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এটি ভাতের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য। যারা একবার চেখে দেখেছেন, তাদের কাছে এই খাবারের স্বাদ থেকে যায় দীর্ঘদিন। মশলার ঝাঁজ, পেঁয়াজের মিষ্টি গন্ধ আর মাংসের কোমলতা মিলেমিশে যে স্বাদের জন্ম দেয়, তা নিঃসন্দেহে অনন্য।
চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী রান্না প্রমাণ করে খাবার কখনো শুধু পেট ভরানোর জন্য নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি আর স্মৃতিরও বাহক। তাই বিফ কালাভুনা এখন শুধু একটি পদ নয়, চট্টগ্রামের গৌরবময় পরিচয়ের অংশ।










