‘গৌরচন্দ্রিকা’ বাংলা ভাষার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং অর্থবহ একটি প্রবাদ। এটি সাধারণত কোনো মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে দীর্ঘ ভূমিকা বা ভূমিকা স্বরূপ কোনো কথা বলাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
নিচে এর উৎপত্তি, উৎস এবং ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. অর্থ
গৌরচন্দ্রিকা শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ‘গৌর’ (শ্রীচৈতন্যদেব) বিষয়ক গান বা বর্ণনা। কিন্তু প্রবাদ হিসেবে এর অর্থ হলো—দীর্ঘ ভূমিকা, অবতরণিকা বা আসল কথা শুরু করার আগে দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা বা পটভূমি তৈরি করা।
২. উৎস ও উৎপত্তি
এই প্রবাদের উৎস মূলত মধ্যযুগীয় বাংলার বৈষ্ণব পদাবলি এবং কীর্তন গান।
শ্রীচৈতন্যদেব: বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে শ্রীচৈতন্যদেব হলেন ‘গৌর’ বা ‘গৌরাঙ্গ’।
কীর্তনের নিয়ম: পদাবলি কীর্তন গাওয়ার সময় একটি বিশেষ নিয়ম ছিল। রাধাকৃষ্ণের লীলা বা প্রেমকাহিনী (যা মূল গান) শুরু করার আগে শ্রীচৈতন্যদেবের মহিমা কীর্তন করা হতো। অর্থাৎ, মূল পর্বে প্রবেশের আগে চৈতন্য-বন্দনা করাটা ছিল আবশ্যিক।
কেন করা হতো: বৈষ্ণব মহাজনদের মতে, শ্রীরাধার ভাব বুঝতে হলে আগে শ্রীচৈতন্যের ভাব বুঝতে হবে। তাই মূল লীলার আগে যে গৌর-বিষয়ক গান গাওয়া হতো, তাকেই বলা হতো ‘গৌরচন্দ্রিকা’।
৩. প্রবাদ হিসেবে ব্যবহার
কালক্রমে কীর্তনের এই ‘গৌরচন্দ্রিকা’ অংশটি সাধারণ কথাবার্তায় একটি প্রবাদ বা বাগধারা হিসেবে জড়িয়ে যায়। যখন কেউ সরাসরি মূল কথা না বলে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক গৌরবে ভূমিকা ফাঁদে, তখন শ্রোতা বিরক্ত হয়ে বা ব্যঙ্গ করে এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
৪. ব্যবহারিক উদাহরণ
বাস্তব জীবনে এর ব্যবহার বৈচিত্র্যময়:
বিরক্তি প্রকাশে: “অনেক তো হলো, এবার ওসব গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলো তো দেখি!”
ব্যঙ্গাত্মক অর্থে: “সে কোনো কাজের কথা বলতে গেলেই আগে আধঘণ্টা গৌরচন্দ্রিকা করে, তারপর কাজের কথা পাড়ে।”
সাহিত্যে বা বক্তৃতায়: লেখক বা বক্তা যখন কোনো গভীর বিষয়ে যাওয়ার আগে দীর্ঘ ভূমিকা দেন, তখন তাকে গৌরচন্দ্রিকা বলা হয়।
৫. প্রাসঙ্গিক তথ্য
| বিষয় | বিবরণ |
| মূল শব্দ | গৌর (শ্রীচৈতন্য) + চন্দ্রিকা (জ্যোতি/প্রকাশ) |
| বিপরীত শব্দ | সারকথা / সরাসরি কথা |
| আধুনিক পরিভাষা | Introduction / Prologue |
সহজ কথায়: কোনো গল্পের মূল ঘটনা শুরু করার আগে যে দীর্ঘ ‘ভূমিকা’ দেওয়া হয়, সেটিই হলো ‘গৌরচন্দ্রিকা’।










