Home First Lead দেশে গ্যাস সংকটের দায় রাজনীতি ও দুর্নীতির: উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

দেশে গ্যাস সংকটের দায় রাজনীতি ও দুর্নীতির: উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

নীতি সহায়তার অভাবে ৯৫ সালের পর কোন ব্যবসায়ী প্রজন্ম আসেনি: আমিরুল হক 

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: দেশে চলমান গ্যাস সংকট কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়—এটি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও ভুল সিদ্ধান্তের ফল বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তাঁর ভাষায়, “গ্যাস খাতের এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি, আর এটা আপনা আপনি হয়নি। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও তাঁদের সহযোগী ব্যবসায়ীরা আমাদের আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।”

শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘বাংলাদেশে এলপিজি: অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে তিনি এ মন্তব্য করেন। দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত এ কনক্লেভে টেকসই এলপিজি অর্থনীতি গড়ে তোলা, পরিবেশগত প্রভাব মোকাবিলা ও নিরাপত্তা জোরদারের দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, “জ্বালানি খাতে পরিকল্পনাহীনতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে আজ আমরা জটিল সংকটে পড়েছি। জ্বালানি নিশ্চিত না করেই চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, গ্যাস খাতে অসংখ্য অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব অপকর্মের পেছনে কিছু রাজনীতিবিদ ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা জড়িত ছিলেন।”

তিনি আরও বলেন, “বিদ্যুতের সরবরাহ এক স্থান থেকে বন্ধ করে অন্য স্থানে দেওয়া সম্ভব হলেও গ্যাসের ক্ষেত্রে তা করা যায় না। গ্যাস সরবরাহ হয় ‘ফার্স্ট কাম, ফার্স্ট সার্ভড’ নীতিতে—অর্থাৎ আগে এলে আগে সেবা পাওয়া যায়। ফলে ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকলে সমস্যার সমাধান অসম্ভব।”

গ্যাস খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল বলেন, “এখনই সময় গ্যাস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় এই সংকট আরও গভীর হবে।”

তবে উপদেষ্টার বক্তব্যের বিরোধিতা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, “রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের গ্যাস মজুত ফুরিয়ে আসছে। এখন থেকেই ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা নিতে হবে—কোথা থেকে নতুন জ্বালানি আসবে, কীভাবে তা টেকসইভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেটিই মূল বিষয়।”

এদিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, “উন্নত দেশের সারিতে যেতে হলে মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে এলপিজি হতে পারে একটি কার্যকর বিকল্প। এলপিজির ব্যবহার বাড়াতে হলে উৎপাদন, আমদানি ও নিরাপত্তা মানে আরও বিনিয়োগ দরকার।”

কনক্লেভে দেশের জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও উন্নয়ন সহযোগীরা অংশ নেন। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

এই আলোচনায় বিশেষভাবে উঠে আসে—বাংলাদেশের জ্বালানি খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পরিকল্পনাভিত্তিক ও টেকসই নীতির আওতায় না আনলে ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

উদ্যোক্তাদের প্রতি অবহেলা ও নীতিগত সমর্থনহীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন আমিরুল হক

আলোচনা সভায় এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি ডেল্টা এলপিজি লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক। দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে গভীর হতাশা এবং সরকারের নীতি প্রণয়নে জনসাধারণের শুনানির অভাব নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন । তিনি উদ্যোক্তাদের “খারাপ লোক”, “অর্থ পাচারকারী” এবং “লুটেরা” হিসেবে অপবাদ দেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেন।

আমিরুল হক বলেন, “কথায় কথায় আমরা শুনি আমরা সবচাইতে খারাপ লোক, আমরা বিদেশে টাকা পাচার করি, আমরা মুনাফা করি, আমরা লুটেরা।” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত যারা ব্যবসা করতে এসেছেন, তারাই এখনো শিল্পে রয়েছেন। ১৯৯৫ সালের পর নতুন কোনো প্রজন্ম ব্যবসা করতে আসেনি, যা দেশের জন্য একটি সংকট।

তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, নীতিগত সমর্থনের অভাবের কারণেই অনেক ব্যবসায়ী নতুন করে শিল্পে আসতে পারছেন না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে গেলেও ব্যবসায়ীরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন তিনি। আমিরুল হক প্রশ্ন তোলেন, “এই যদি ব্যবসায়ীদের জায়গা হয়, তাহলে ব্যবসা কে করবে? নেক্সট জেনারেশন কি ব্যবসা করতে আসবে?”

নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার অভাবের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সরকার কোনো পাবলিক হেয়ারিং (জনসাধারণের শুনানি) ছাড়াই নীতি তৈরি করে, বাজেট প্রণয়ন করে এবং বছরের মাঝামাঝি সময়ে কর আরোপ করে। তিনি এই বিষয়টিকে “কোন ডোমেইনে আমরা আছি, স্যার?” বলে প্রশ্ন তোলেন।

এলপিজি খাতে ভর্তুকি না দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি এখানে ভর্তুকির জন্য ভিক্ষা করতে আসিনি। আমি এখানে এসেছি একটি সমান্তরাল সমাজের জন্য।”

দেশের শিল্পপতিদের সক্ষমতা তুলে ধরে আমিরুল হক বলেন, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস, গার্মেন্টস, সিমেন্ট, স্টিল এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প বিদেশিদের দ্বারা নয়, বরং দেশীয় উদ্যোক্তাদের দ্বারাই বিকশিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই শিল্পগুলোতে বিদেশিদের কোনো প্রয়োজন নেই, এবং বাংলাদেশিরাই তা সফলভাবে পরিচালনা করতে পারে।

মাতারবাড়ীতে জমি ও প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে তিনি ও তার মতো আরও পাঁচজন শিল্পপতি দু’বছরের মধ্যে ভেরি লার্জ গ্যাস কেরিয়ার (VLGC) আনতে পারবেন, যা সরকারের পাঁচ বছর সময় লাগে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমার মতো আরও দশজন শিল্পপতি আছে। আমরা কি করতে পারি না?”

দেশের মেধাবী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমি বিদেশে গেলে বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশে আমার হাত বাঁধা। বাংলাদেশের এমডি দুই বছর পরে দেখবেন ২০ জন চলে গেছে।”

শেষে তিনি নীতি প্রণয়ন, মূল্য বৃদ্ধি বা কমানো এবং কর আরোপের ক্ষেত্রে জন শুনানির দাবি জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার কর্ণফুলী টানেল বা ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে পারে, ৩০০০ কিলোমিটার রেলওয়ে লাইন স্থাপন করতে পারে, কিন্তু ১০০ কিলোমিটার ঢাকা-চট্টগ্রাম কর্ড লাইন তৈরি করতে পারে না, আর এর জন্য ব্যবসায়ীদের দায় চাপানো হয়। তিনি বলেন, “আমি গালি দেওয়ার জন্য আসিনি, আমি উত্তর দিতে এসেছি।”